অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা

জেসমিন পাপড়ি ও তুষার তুহিন
2017.12.27
ঢাকা ও কক্সবাজার
অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা ২৫ ডিসেম্বর নয় হাজার ৮২১টি ইয়াবাসহ দু’রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবি। ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭।
তুষার তুহিন/ বেনারনিউজ

মিয়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৪ মাসে ৬০৭ জনকে রোহিঙ্গাকে সাজা দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

একই সময়ে ৪৫ জন ইয়াবা পাচারকারীর কাছ থেকে প্রায় ১৬ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) খালেদ মাহমুদ বেনারনিউজকে জানান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনের দেওয়া ৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসনের ২ জন কর্মকর্তা ও ৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছেন। তারা এ পর্যন্ত ৬০৭ জন রোহিঙ্গাকে নানা অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, গত ৪ মাসে হত্যা, ইয়াবা বহন ও কেনাবেচা, চুরি, ডাকাতি, মারামারি ও মানবপাচারের অভিযোগে ২৮টি মামলায় ৪১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি ও দাসহ র‍্যাব আরও ১১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।

কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরাজুল হক টুটুল বলেন, ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে ৫৫০ জন রোহিঙ্গাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দুই বছর থেকে সর্বনিম্ন ২ মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইয়াবা পাচার, মানব পাচার, খুন, মারামারি ও পুলিশকে নাজেহাল করার দায়ে বৈদেশিক আইনে ২৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় ৪১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে গড়ে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার ইয়াবা করা উদ্ধার হয়েছে।

এ ছাড়া রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য টেকনাফ-কক্সবাজার রোডে পুলিশের ১১টি তল্লাশি চৌকি, র‍্যাবের দুটি এবং বিজিবির দুটি তল্লাশি চৌকি বসানো আছে। এর পাশাপাশি সেনাবাহিনীরও একাধিক তল্লাশি চৌকি রয়েছে।

আফরাজুল বলেন, “রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জেলায় যাতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে পুলিশ। এ জন্য উখিয়া, টেকনাফ ও রামুর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। রামুর গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তায় কাজ করছে ১৫০ জন পুলিশ।”

জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখনো প্রতিদিন সীমান্তের নানা পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।

 

নিরাপত্তা শঙ্কায় স্থানীয়রা

উখিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাহামুদুল হক চৌধুরী বেনারনিউজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। স্থানীয়রা এখন রোহিঙ্গাদের ভয়ে তটস্থ। তিন দিন আগে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে একটি বাসে ডাকাতি হয়েছে। অথচ এই সড়কে গত ৫ বছরে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ ছাড়া কক্সবাজারে ইয়াবার কেনাবেচা বেড়ে গেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও স্বাভাবিক নয়।”

রোহিঙ্গাদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ সম্পর্কে র‍্যাব-৭ এর কক্সবাজার ক্যাম্প কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন বলেন, “শুধু রোহিঙ্গা নয়, পৃথিবীর সকল বাস্তুচ্যুত লোকজনের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা একটু বেশি। সবকিছু হারিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়া লোকগুলোর অনেকে ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। টাকার লোভে তারা নিজেদের মধ্যেও বিভেদে জড়ায়। এসব কারণে এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের এটি অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।”

তবে উখিয়ার কতুপালংয়ের আমতলী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) আবদুল হাফিজ বলেন, “এটা সত্য যে, কতিপয় রোহিঙ্গা টাকার লোভে খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে আমরা এখানে যারা আশ্রয় নিয়েছি তারা বিব্রত। তবে রোহিঙ্গারা যাতে অন্যায় পথে, ভুল পথে পা না বাড়ায় সেদিকে আমরা সজাগ দৃষ্টি রাখছি। আমরা নানা সময় রোহিঙ্গাদের নিয়ে উঠোন বৈঠক করি। তাদের ভুল পথে পরিচালিত না হতে পরামর্শ দিই।”

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর

টেকনাফে বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল এস. এম আরিফুল ইসলাম বেনারনিউজকে জানান, গত চার মাসে ২৬ জন পাচারকারীর কাছ থেকে ৫ লাখ ৫৯ হাজার ৬০৬টি ইয়াবা উদ্ধার করেছে বিজিবি। একই সময়ে টাকার বিনিময়ে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের পারাপার, আশ্রয়ের নামে অর্থ আদায়সহ নানা অপরাধে ৫১ জন রোহিঙ্গাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ন্যূনতম ৬ মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “ছোটখাটো অপরাধের ক্ষেত্রে অনেক রোহিঙ্গাকে সাবধান করে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। উপায় নেই। কারণ এদের আটক করলে আমাদের কারাগারে জায়গা হবে না। ”

র‍্যাব-৭ এর কক্সবাজার ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন বলেন, “আমরা এক মাসের মত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও সীমান্তে কাজ করেছি। এ সময়ে ১১ জন রোহিঙ্গাকে ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করেছি। তাদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫ জন রোহিঙ্গাকে ৮ লাখ ৯ হাজার ৮০০টি ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করেছি। বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৬ জনকে রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।