দ্বিতীয় দলে ভাসানচর পৌঁছালেন ১৮শ’র বেশি রোহিঙ্গা
2020.12.29
কক্সবাজার ও ঢাকা

কক্সবাজার থেকে মঙ্গলবার ভাসানচর গিয়ে পৌঁছেছেন ১৮শ’র বেশি নতুন রোহিঙ্গা। ফলে নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত বঙ্গোপসাগরের ওই দ্বীপে শরণার্থী বাসিন্দার সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে সাড়ে তিন হাজার।
কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ধাপে চট্টগ্রাম থেকে নৌবাহিনীর পাচঁটি জাহাজে করে এক হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গা মঙ্গলবার দুপুরে ওই দ্বীপে পৌঁছান বলে বেনারকে জানান ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আবাসন প্রকল্পের পরিচালক কমান্ডার এম আনোয়ারুল কবির।
এই দফায় ভাসানচরে পৌঁছানো রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৪৩৩ জন পুরুষ, ৫২৩ জন নারী এবং ৮৪৮টি শিশু বলে বেনারকে জানান নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) খোরশেদ আলম খান।
ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন শিবির থেকে সোমবার উখিয়ার কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে আনা হয়। সেখান থেকে কড়া নিরাপত্তায় বাসে করে তাঁদের চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম থেকে তাঁরা এসে পৌঁছান ভাসানচর।
অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে গত মে মাসে ভাসানচর নিয়ে যায় সরকার। গত ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় স্বেচ্ছায় কক্সবাজার থেকে ভাসানচর যান এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা। ভাসানচর যাবার পর এই রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে জন্ম নেয় চারটি শিশু। সর্বশেষ সেখানে গিয়ে পৌঁছালেন আরো এক হাজার ৮০৪ জন।
ফলে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার স্থানান্তর নিয়ে বিরোধিতার মধ্যেও ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বর্তমান সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৭৫৬ জন।
স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের ভাসনচর যাওয়ার ঘটনা ওই দ্বীপ সম্পর্কে তাঁদের ভীতি কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে ভাসানচরে যাচ্ছে, মানে তারা বুঝতে পেরেছে, সেখানেকার সুযোগ সুবিধা কক্সবাজার তুলনায় ভালো। ভাসানচর নিয়ে তাদের যে ভীতি ছিল সেটা কেটে যাচ্ছে।”
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য কূটনীতি অনেকটাই শ্লথ হয়ে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে কতটুকু বাধ্য করতে পারবে জানি না। কারণ, আমাদের প্রতিবেশী বড়ো রাষ্ট্র ভারত এবং চীন মুখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা বললেও নিজ স্বার্থের কারণে মিয়ানমারকে চাপ দিতে বা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে পারবে না। মিয়ানমার সে সুযোগ কাজে লাগাবে।”
এছাড়া আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে সুরক্ষা বিষয়ে যে মামলা হয়েছে সেটার রায় পেতে অন্তত সাত-আট বছর লেগে যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “ভাসানচরের মতো আরো আবাসন প্রকল্প রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজন।”
“কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে দিতে হবে। না হলে সেখানে আরো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে,” বলেন তিনি।
তারেক শামসুর রেহমানের মতে, “ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। সে জন্য সরকারের উচিত টেকনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট করার অনুমতিসহ জাতিসংঘকে ভাসানচরে প্রবেশাধিকার দেওয়া।”
প্রাথমিকভাবে ‘ভালো লেগেছে’ ভাসানচর
“পৌঁছানোর পর ভাসানচর ভালোই লেগেছে,” বলে মুঠোফোনে বেনারকে জানান রোহিঙ্গা মো. রশিদ আহমদ। টেকনাফের শামলাপুর শিবির থেকে মঙ্গলবার ভাসানচরে গেছেন তিনি।
“এখানকার রাস্তাঘাট খুব সুন্দর,” জানিয়ে রশিদ বলেন, “যতটুকু বুঝেছি, এটি আসলে পানির জায়গা। চারদিকে পানি। মাঝখানে আমরা।”
“তবে কিছুদিন থাকার পরেই পুরোপুরি বলতে পারব এটি আসলে কেমন,” বলেন রশিদ।
তিনি জানান, ভাসানচরে পৌঁছানোর পর আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাঁর পরিবারের চার সদস্যের জন্য দুই কক্ষের একটি ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
মিয়ানমার থেকে ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে পাড়ি জমানো জাহেদ হোসাইনও মঙ্গলবার দুপুরে ভাসানচরে পৌঁছেন।
“পরিবারের ৮ সদস্যকে নিয়ে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে এসেছি,” জানিয়ে সেখান থেকে মুঠোফোনে তিনি বেনারকে বলেন, “একদিনেই বলা যাবে না ভাসানচর আসলে কেমন। প্রাথমিকভাবে বলি এখানকার পরিবেশ ভালো লেগেছে।”
পরিবারের ৮ সদস্যের জন্য তাঁরা তিন কক্ষের ঘর পেয়েছেন বলে জানান জাহেদ।
“খোলামেলা জায়গা পেয়ে আমার সন্তানরা অনেক বেশি খুশি হয়েছে,” বলেন তিনি।
ভাসানচরে ৪ শিশুর জন্ম
প্রথম দফায় গত ৪ ডিসেম্বর ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে চার নারী চারটি সন্তান জন্ম দিয়েছেন বলে বেনারকে জানান কমান্ডার এম আনোয়ারুল কবির।
“বর্তমানে মা-সন্তানরা সবাই ভালো আছেন,” জানিয়ে তিনি বলেন, সিভিল সার্জন অফিস ও সেখানে কর্মরত এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে এসব শিশুদের টিকাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে।
এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা যে ৩০৬ রোহিঙ্গা গত মে মাস থেকে ভাসানচরে রয়েছেন তাঁদেরকে কক্সবাজারে স্বজনদের কাছে ফেরানো হবে।
তবে তাঁদেরকে কবে ফেরানো হবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান এম আনোয়ারুল কবির।
তাঁদের কক্সবাজার ফেরানোর বিষয়ে “আলোচনা চলছে” জানিয়ে তিনি বলেন, “সিদ্ধান্ত হলে তাঁদের ক্যাম্পে নিয়ে আসা হবে।”
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আগে আশ্রয় নেওয়াসহ বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছেন।
কক্সবাজার থেকে শরণার্থীদের চাপ কমাতে দুই বছর আগে অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নৌবাহিনীর তত্বাবধানে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
ভাসানচরের পুরো আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।