রোহিঙ্গা স্থানান্তর: জাতিসংঘকে এখনো ভাসানচর যাবার অনুমতি দেয়নি সরকার

ইমরান ভিটাচি ও শরীফ খিয়াম
2020.12.31
ওয়াশিংটন ডিসি ও ঢাকা
রোহিঙ্গা স্থানান্তর: জাতিসংঘকে এখনো ভাসানচর যাবার অনুমতি দেয়নি সরকার ভাসানচরে পৌঁছার পর রোহিঙ্গাদের জাহাজ থেকে নামতে সহায়তা করছেন নৌবাহিনীর সদস্যরা। ২৯ ডিসেম্বর ২০২০।
[রয়টার্স]

বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগে জাতিসংঘের অংশগ্রহণের বিষয়ে সহযোগিতার কথা বললেও সরকার তাদেরকে এখানো সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। 

“জাতিসংঘ অব্যাহতভাবে ভাসানচরে কারিগরি ও সুরক্ষা মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়ে আসছে, তবে সরকার এখনও আমাদের এ বিষয়ে অনুমতি দেয়নি,” বৃহস্পতিবার জেনেভা থেকে বেনারকে জানান জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সংবাদ ও মিডিয়া বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান আন্দ্রেজ মাহেকিক।

“জাতিসংঘ সরকারের ভাসানচর প্রকল্পের সাথে কার্যকরভাবে যুক্ত হতে পারবে কিনা তা নির্ধারণের জন্য এটাই (মূল্যায়নের অনুমতি) হবে সুনির্দিষ্ট পরবর্তী পদক্ষেপ,” যোগ করেন তিনি। 

দ্বিতীয় দফায় মঙ্গলবার এক হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ওই দ্বীপে নেওয়ার পর বুধবার এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, “বাংলাদেশ সরকার এই প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে পূর্বের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছে এবং এক্ষেত্রে জাতিসংঘের অংশগ্রহণ বিষয়ে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।” 

বিবৃতিতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ার বিরোধিতা না করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার প্রতিও আহবান জানায় সরকার সরকার। 

এর আগে ১০ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বেনারকে বলেন, ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ কখনো সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি দেয়নি। জাতিসংঘ ভাসানচরে যেতে চাইলে সরকারের কোনো আপত্তি নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 

এ বিষয়ক ই-মেইলের জবাবে ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা আন্দ্রেজ মাহেকিক বেনারকে জানান, “আমরা সরকারের সাথে গঠনমূলক সংলাপ চালিয়ে যেতে এবং তাদের পরিকল্পনার বিষয়ে আরো তথ্য পেতে অনুরোধ অব্যাহত রেখেছি।” 

শরণার্থীদের বসবাসের উপযোগিতা যাচাইয়ে স্বাধীনভাবে মূল্যায়নের সুযোগ না দিয়ে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের শুরু থেকেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছে জাতিসংঘ। 

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়খালীর দ্বীপ ভাসানচরে পাঠানোর সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে প্রথম দফায় গত ৪ ডিসেম্বর এক হাজার ৬৪২ জনকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়। 

কারাগারে রোহিঙ্গা আলোকচিত্রী

উখিয়ার কুতুপালংয়ে ভাসানচরগামী শরণার্থীদের ছবি তোলার কারণে সোমবার আবুল কালাম (৩৮) নামের এক রোহিঙ্গা আলোকচিত্রীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের মতে পুরোনো এক মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বৃহস্পতিবার। 

সরকারি কাজে বাধাদান ও কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের পুরানো একটি মামলার অজ্ঞাতনামা আসামিদের মধ্যে একজন হিসেবে তাঁকে বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করা হয়ে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গাজী সালাহ উদ্দিন। 

“কুতুপালং মেগা ক্যাম্পের চারটি শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (সিআইসি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. খলিলুর রহমান গত ২৮ মে দুপুরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গেলে দা, ছুরি, ইট ও লাঠি নিয়ে রোহিঙ্গারা ওই হামলা করেছিল,” বলেন তিনি। 

তিনি জানান, সিআইসির পক্ষ থেকে কালামকে বৃহস্পতিবার সকালে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করার পর আদালতে হাজির করলে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছে কক্সবাজারের আদালত। 

তবে কুতুপালংয়ের নিবন্ধিত শিবিরের চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে দ্বিতীয় দফায় রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের দিন সকালে ছবি তোলার সময় ক্যাম্পের ডি-ব্লকের সামনে থেকে সরকারি লোকজন আবুল কালামকে ধরে নিয়ে যায়। সিআইসির কার্যালয়ে তিন দিন আটকে রেখে তাঁকে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।” 

মিয়ানমারের মংডু জেলার বোরগোজবিল এলাকা থেকে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন কালাম। ২৮ বছর ধরে কুতুপালংয়ের নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা কালাম চার সন্তানের জনক। 

তাঁর স্ত্রী সৈয়দা বেগম বেনারকে বলেন, “সোমবার ভাসানচরে যাওয়া বোনের ছবি তোলার সময় কিছু লোক আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়ে সিআইসির হাতে তুলে দেয়। তাঁকে বিনাদোষে মারধর করে বৃহস্পতিবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে।” 

তবে আবুল কালামকে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে সিআইসি খলিলুর বেনারকে বলেন, “আবুল কালাম নামে এক রোহিঙ্গাকে ধরে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। তাঁর কাছে অবৈধ জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে।” 

সোমবার আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা কালামকে আটক করে বলে জানান এই উপ-সচিব।

তবে আটকের তিনদিন পর কালামকে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সরাসরি কোনো জবাব দেননি তিনি। 

কালামের বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল বলে বেনারকে জানান তাঁর স্ত্রী সৈয়দা বেগম। তবে তাঁর স্বামী সেটি কীভাবে পেয়েছেন তা তাঁর জানা নেই বলে জানান তিনি। 

দেশি-বিদেশি বিশিষ্টজনদের উদ্বেগ

রোহিঙ্গা ফটোগ্রাফার আবুল কালামকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশি-বিদেশি মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিকরা। সর্বমোট ৩৩ জন বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে কালামের মুক্তির দাবি জানান। 

“ফটোগ্রাফি কোনো অপরাধ নয়,” উল্লেখ করে তাঁরা বিবৃতিতে বলেন, পুরস্কারপ্রাপ্ত ফটোগ্রাফার এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী আবুল কালাম কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ছেড়ে যাওয়া ভাসানচরগামী বাসের ছবি তুলতে বেরিয়েছিলেন। 

ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর কোনো গোপন বিষয় নয় উল্লেখ করে এই বিবৃতিদাতারাও আটকের পর কালামকে মারধরও করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। 

বিবৃতিদাতাদের একজন যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও সাংবাদিক শফিউর রহমান বেনারকে ইমেইলে জানান, বাংলাদেশে কোনো রোহিঙ্গা আলোকচিত্রী গ্রেপ্তারের ঘটনা এটাই প্রথম। 

বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মী নূর খান বেনারকে বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আটকের ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে হাজিরের বাধ্যবাধকতা থাকার পরও তাঁকে প্রায় ৭২ ঘন্টার মধ্যেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপার্দ করা হয়নি।” 

পুরোনো একটি মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “হয়রানির জন্য বাংলাদেশে এটা বহুল চর্চিত একটি পুরানো কৌশল। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা উচিত।” 

কালামকে তুলে নেওয়ার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা আরেক রোহিঙ্গা আলোচিত্রী নিরাপত্তাজনিত কারণে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “তাঁকে আটক হতে দেখে আমি ভয় পেয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করি।” 

চলতি বছর সারা বিশ্বের রোহিঙ্গাদের জন্য আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার আয়োজনকারী শফিউর বলেন, “প্রতিযোগিতার চার মাসেরও বেশি সময় সারা বিশ্বের মানুষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সৃজনশীলতার পাশাপাশি তাঁদের সাংবাদিকতা এবং শৈল্পিক দক্ষতায় মুগ্ধ ছিল। তাই আমি প্রচুর আশাবাদী।” 

“তবে তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগগুলো দেওয়া দরকার। যদি তাঁদের সেই অনুমতি না দেওয়া হয় তবে এই সম্ভবনাকে দমন করা হবে,” যোগ করেন তিনি। 

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি এবং কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।