রোহিঙ্গা নেতা মুহিব হত্যা: সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে আরসা
2021.10.01
ঢাকা ও কক্সবাজার

কক্সবাজার উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মো. মুহিব উল্লাহকে (৫০) হত্যার ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এই ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি দাবি করেছে উগ্রবাদী রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা)।
ওই হত্যার ঘটনায় শুক্রবার সকালে সন্দেহভাজন হিসেবে শরণার্থী শিবির থেকে মো. ছলিম উল্লাহ (২৭) ওরফে লম্বা ছলিম নামে এক রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বেনারকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাঈমুল হক।
শুক্রবার আরসা’র কমান্ডার ইন চিফের স্বাক্ষরে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, “এই খুনের ঘটনায় দোষীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং এটা একে অপরকে ভিত্তিহীনভাবে দোষারোপের সময় নয়।”
বুধবার রাতে নিহতের ভাই মুহিব উল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, হত্যার পেছনে আরসা সন্ত্রাসীরা জড়িত। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে উখিয়া থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে হত্যা মামলায় কাউকে আসামি না করে কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রুপের কথা বলা হয়েছে।
আরসা’র উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নাঈমুল বেনারকে বলেন, “আরসা বা আল ইয়াকিন এর কোনো অস্তিত্ব ক্যাম্পে নেই। এই হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তারা আরসা কিনা, তা তদন্তের পর জানা যাবে। যদি এ ধরনের কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ক্যাম্পে থেকে থাকে তাহলে আমরা আপনাদের অবশ্যই জানাব।”
পুলিশ জানায়, শুক্রবার সকাল এগারোটার দিকে কুতুপালংয়ের ৬ নম্বর রোহিঙ্গা শিবির এলাকা থেকে ছলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
“বুধবার রাতে হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন ছলিম। সোর্সের মাধ্যমে শুক্রবার সকালে তাঁকে গ্রেপ্তারের পর উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে,” জানান নাঈমুল।
তবে হত্যাকাণ্ডে ছলিমের সম্পৃক্ততার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি পুলিশ।
“এই মামলা নিয়ে আপাতত বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না,” বলে বেনারকে জানান উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাম্মদ মনজুর মোর্শেদ।
মুহিব উল্লাহ হত্যায় “অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, গ্রেপ্তার ছলিমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চাওয়া হবে।
“প্রাথমিক অনুসন্ধানে পুলিশের ধারণা, ছলিম ওই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারেন,” যোগ করেন মোর্শেদ।
বৃহস্পতিবার দায়ের করা হত্যা মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে উখিয়া থানার উপ-পরিদর্শক কার্ত্তিক চন্দ্র পালকে। কার্ত্তিক বেনারকে বলেন, মুহিব উল্লাহকে হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত ‘সুনির্দিষ্টভাবে’ কাউকে শনাক্ত করা যায়নি।
বুধবার রাতে ক্যাম্পের ভিতর নিজ কার্যালয়ে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হাতে খুন হন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিব। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কয়েকটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধের জের ধরে এ ঘটনা ঘটতে পারে।

আতঙ্কে মুহিবের পরিবার
“ঘটনার পর থেকে আমার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বর্তমানে আমরা খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে অনুরোধ করব, আমাদের পরিবারকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিন,” বেনারকে বলেন হাবিব।
এ প্রসঙ্গে নাঈমুল বলেন, “মুহিব উল্লাহর পরিবারকে আমাদের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। ফলে মনে হচ্ছে না তাঁরা এখানে অনিরাপদ আছেন। পাশাপাশি তাঁদের সব সময় খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে।”
বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ক্যাম্প এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি এ ঘটনায় সঙ্গে জড়িতদের ধরতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে বলে জানান তিনি।
মামলার বাদী হাবিবুল্লাহকে বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি প্রদান করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন উখিয়া ক্যাম্পের আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের নারী নেত্রী জামালিদা বেগম।
“শুক্রবার সকালে মুহিব উল্লাহ’র পরিবারকে দেখতে গিয়েছিলাম,” জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “হাবিব উল্লাহ মামলা করার পর থেকে বিভিন্ন দিক থেকে হুমকি পাচ্ছেন। এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে যারা রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা সবাই আতঙ্কের মধ্য রয়েছেন।”
তদন্ত চান জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনার
শুক্রবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিচেল ব্যাচলেট মুহিব হত্যার ঘটনায় গভীর শোক, উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা অধিকার কর্মী মুহিব উল্লাহকে হত্যার ঘটনায় একটি যথাযথ ও কার্যকর তদন্তের আহবান জানাই।”
“নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের অধিকার আদায়ের জন্য যিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিত তাঁর এমন মৃত্যু সত্যিই হৃদয়বিদারক,” বলেন ব্যাচলেট।
এদিকে মুহিব উল্লাহকে হত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে ২৭টি আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সংগঠন।
এক যৌথ বিবৃতিতে মুহিব উল্লাহকে হত্যার ঘটনায় ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি আরো নাজুক ও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে উল্লেখ্য করে শরণার্থী শিবিরের ভেতর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সক্রিয় হওয়ার আহবান জানিয়েছে সংগঠনগুলো।
“মুহিব উল্লাহর ভাই হাবিব উল্লাহ জানিয়েছেন এই হত্যাকাণ্ডের সাথে আরসা সন্ত্রাসীরা জড়িত। আরসা সদস্যদের হাতে প্রতিনিয়তই ক্যাম্পের নিরীহ মানুষেরা ছিনতাই, হয়রানি এমনকি খুনের শিকার হয়,” বলা হয় বিবৃতিতে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে, আরাকান রোহিঙ্গা ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-অস্ট্রেলিয়া, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এআরএনও), অস্ট্রেলিয়ান বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন, ব্রিটিশ রোহিঙ্গা কমিউনিটি ইন ইউকে, বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন- জাপান, কানাডিয়ান বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন, ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিল (ইআরসি), রোহিঙ্গা অ্যাকশন আয়ারল্যান্ড, রোহিঙ্গা আমেরিকান সোসাইটি এবং রোহিঙ্গা সোসাইটি মালয়েশিয়া।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। বর্তমানে নতুন ও পুরানো মিলে কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবির এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে বসবাস করছেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা।