চরম ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ভূমিতে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে
2018.03.27
ঢাকা
আগামী বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই ভূমিধস, বন্যা, সাইক্লোনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে উখিয়ার পাহাড়ে চরম ঝুঁকির মুখে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে সরকার।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শরণার্থী বিষয়ক সরকারি সেলের প্রধান ও যুগ্ম-সচিব মোহাম্মদ হাবিবুল কবির চৌধুরী বেনারকে এ কথা জানিয়েছেন।
আগামী মৌসুমে রোহিঙ্গাদের ঝুঁকি নিয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে করা গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে চরম বিপদে থাকা ১১ হাজার রোহিঙ্গাকে ইতিমধ্যে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে জানান তিনি। গত দুই সপ্তাহের মধ্যে কয়েকভাগে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি আরও ১৪ হাজার অর্থাৎ মোট ২৫ হাজার রোহিঙ্গাকে উখিয়ার পাহাড়ে বিপজ্জনকভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে বলেও জানান হাবিবুল কবির।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়ান ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেসের এক গবেষণায় বলা হয়, উখিয়ার বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় দুই লাখ মানুষ আগামী বর্ষী মৌসুমে ভূমিধস, বন্যা ও সাইক্লোনের ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।
তাঁর মতে, একই স্টাডিতে বলা হয়েছে, উখিয়ার পাহাড়ে বসবাসরত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা দুর্যোগের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। তারা সবচেয়ে বিপদে আছে।
হাবিবুল কবির চৌধুরী বলেন, “এশিয়ান ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেসের ওই গবেষণায় যে দুই লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গাকে উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে। আর বাকিদের নেওয়া হবে নোয়াখালী জেলার ভাসানচর এলাকায়।”
তিনি বলেন, “সেই ঝুঁকির সম্ভাব্যতা মাথায় রেখে আমরা ইতিমধ্যে ওই ২৫ হাজারের মধ্যে ১১ হাজার মানুষকে উখিয়ার লাম্বারশিয়া ক্যাম্পের পাশে ১২৩ একর জমিতে সরিয়ে নিয়েছি। আগামী মাসের মাঝামাঝি আমরা নতুন ওই ১২৩ একর ভূমিতে ২৫ হাজার মানুষকেই সরিয়ে নিতে পারবো।”
শরণার্থী বিষয়ক সেলের প্রধান বলেন, “আমরা আশা করছি উখিয়ায় আরও নতুন জমি অধিগ্রহণ করে বাকি ৭৫ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা রোহিঙ্গাদের বাড়িগুলোকে পরিকল্পিতভাবে মেরামত করে দেব যেন সেগুলো সামান্য ঝড়ে ভেঙে না যায়।”
এশিয়ান ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেসের ওই গবেষণার আলোকে প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘর লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করতে ইউএনএইচসিআর, আইওএম এবং ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
অগ্রগতি নেই ভাসানচরে
গত ১৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর অফিসে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে।
“তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বলতে পারি, এখনো এ ব্যাপারে তেমন কিছু হয়নি। বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী ভূমি উন্নয়নের কাজ করছে। কবে নাগাদ তা শেষ হবে তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন,” বলেন হাবিবুল কবির চৌধুরী।
তিনি বলেন, “ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ, দাতা সংস্থা ও বিদেশিদের অনেক প্রশ্ন আছে। আমরা এ সকল বিষয়ে কাজ করছি।”
শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “উখিয়ার বিভিন্ন শিবিরে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের মতামত নিয়েই তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আমরা চাই না বর্ষা মৌসুমে কোনো প্রাণহানি হোক।”
শুক্রবার রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর ভাসানচরে সরিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ২৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচের প্রায় পুরোটাই নিজেদের খরচে বাংলাদেশ সরকার। সরকার এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সাহায্য আহ্বান করার চিন্তা-ভাবনা করছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, কোনো রোহিঙ্গাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভাসানচরে পাঠানো হবে না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক কনসালট্যান্ট আব্দুল লতিফ বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর উখিয়ার পাহাড়ে গাছ কেটে ঘর বানিয়েছে। তারা সেসময় কোনোভাবে জীবন ধারণের ব্যবস্থা করেছে।”
“এখন যারা ঝুঁকিতে বসবাস করছে তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিলেই হবে না। তাদের পরিকল্পিতভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ যদি তাদের অবস্থান দীর্ঘায়িত হয় সে ক্ষেত্রে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে,” বলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে হাবিবুল কবির চৌধুরী বলেন, “আমরা যেখানে তাদের সরিয়ে নিচ্ছি সেই শরণার্থীশিবিরগুলো পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হবে। সেখানকার ঘরগুলো বাঁশ ও প্লাস্টিকের তৈরি হবে। কিন্তু সেগুলো হবে অনেক মজবুত। টিন দিয়ে ছাদ দেওয়া হবে না। টিন বিপজ্জনক সামগ্রী।”
একই সাথে সেখানে বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ও পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকবে বলে তিনি জানান।
“আমার ঘর ছিল খুবই নড়বড়ে। রাতে বাতাসে নড়তো।মনে হতো যে, একটু জোরে বাতাস হলেই ঘর উড়ে যাবে; আমাদের খোলা আকাশের নিচে থাকতে হবে। আল্লাহর রহমতে, এখন একটি ভালো ঘর পেয়েছি। এখন একটু ভালো করে ঘুমাতে পারব,” বেনারকে বলেন লাম্বারশিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা সাদিকুল ইসলাম।