২০১৭: রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বছর
2017.12.28
ঢাকা ও নয়াদিল্লি

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী আবদুল মাসুদ উদ্বিগ্ন। মনে শঙ্কা, হয় তো খুব শিগগিরই তাঁদের জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। মাত্র কয়েক মাস আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাঁর আত্মীয়স্বজনকে নির্বিচারে খুন করেছে, পুরো গ্রাম জ¦ালিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের দিকে ছুটতে থাকা অন্য রোহিঙ্গা মুসলিমদের সঙ্গে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। তারপর বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় ঢুকে পড়েছেন। সহিংসতা আর নির্যাতন এড়াতে তাঁদের ভিটে-মাটি ছেড়ে আসতে হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হাত মিলিয়েছিল। তারপরই নেমেছিল নিধন যজ্ঞে। জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এই অভিযানের নাম দিয়েছেন ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বা জাতিগত নিধন।
“যদি ফেরত পাঠানো হয়, তাহলে আমাদের জন্য আর কোনো আশাই রইল না। আমাদের মেরে ফেলা হবে বা নির্যাতন করতে করতে শেষ করে দেওয়া হবে। যে কোনো রোহিঙ্গাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, কেউ ফিরতে চায় না, মিয়ানমার সরকার যতই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিক,” মাসুদ (২৮) বেনারনিউজকে বলছিলেন।
মাসুদ, তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তানও আগস্টের শেষার্ধ থেকে আসা ৬ লাখ ৫৫ হাজার শরণার্থীদের মতো বাংলাদেশে এসেছে। বাংলাদেশ শরণার্থীদের এমন ঢল আগে কখনো দেখেনি। যদিও আরও আগে থেকেই বাংলাদেশে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। থেমে থেমে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা হয়েছে। প্রতিবারই জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে চলে এসেছেন।
“আমরা সত্যিই এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তবে আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাধ্য মতো কাজ করেছি,” বাংলাদেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব মো. শাহ কামাল বেনারনিউজকে বলছিলেন। তিনি আরও বলছিলেন, “কিন্তু লম্বা সময় ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি আমাদের আওতার বাইরে চলে যেতে পারে।”
শরণার্থী ঢলের মাত্রা ও গতি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ভাষায় বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত ঘটে চলা শরণার্থী সমস্যা। তিনি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশে মানব বিপর্যয় এড়াতে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে সেনা অভিযান বন্ধের আহ্বান জানান।
গত ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) মিয়ানমার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ফাঁড়িতে হামলার জবাব দিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে।
প্রথম মাসেই মিয়ানমারে ৬ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস এর হিসেবে নিহতদের মধ্যে পাঁচ বছরের নিচে শিশু ছিল ৭৩০জন।
জেনেভা ভিত্তিক এই আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বলছে, গুলি করে, বাড়িতে আগুন জ¦ালিয়ে , পিটিয়ে মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়। তারা আরও বলেছে, যতরকম বর্বরতার প্রকাশ ঘটানো যায় তার সবটাই ঘটেছে ২৫ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
“আমরা বাংলাদেশের সব কটি শরণার্থীশিবিরে যাইনি, আমরা ধারণা করছি মৃতের যে সংখ্যা আমরা বলছি, তার চেয়েও বেশি মানুষ মারা গেছেন। যারা মিয়ানমার ছেড়ে পালানোর আগেই মারা গেছে, তাদের আমরা গণনায় ধরতে পারিনি। আমরা এমনও শুনেছি যে গোটা পরিবারকে ঘরবন্দী করে বাইরে থেকে আগুন জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়েছে,” এমএসএফের পরিচালক সিডনি ওং বলছিলেন।
মিয়ানমার সরকার বরাবর এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে এবং সহিংসতার জন্য আরসাকে দায়ী করে আসছে।
“সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে, সৈন্যরা আমাদের গ্রামে ঢুকে পড়ে। তারা আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলে, নইলে মরতে হবে বলে শাসায়। তারা নির্বিচারে গুলি ছুড়তে থাকে। আমার মা, বাবা, দুই ভাই ও গ্রামের আরও অনেকে মারা যায়,” মাসুদ বলছিলেন। কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থীশিবিরের একটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে পুরো পরিবার নিয়ে উঠেছেন তিনি।
“তারপর তারা একটার পর একটা বাড়িতে আগুন দিতে লাগল। আমাদের গ্রামে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।”
ফ্রান্সিস: ‘আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
নতুন করে আসা শরণার্থীদের মুখ থেকে এই নির্মমতার বিবরণ মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া , মালয়েশিয়া ও মুসলিম প্রধান দেশগুলোয় মানুষ রাস্তায় নেমে মিছিল সমাবেশ করেছেন।
রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রীয় পরিচয় বিহীন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। কয়েক দশক ধরে এই জনগোষ্ঠী বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাদের ‘বেঙ্গলি’ ও বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আসা অভিবাসী বলে ব্যঙ্গ করে থাকে।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের এই দুর্দশা নজর কাড়ে পোপ ফ্রান্সিসের। তিনি মিয়ানমার ও বাংলাদেশে যান। বাংলাদেশে তাঁর সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি দলের সাক্ষাৎ হয়। এই পর্বটি ছিল অত্যন্ত বেদনাবিধুর।
“ আমি সকলের পক্ষ থেকে, যারা আপনাদের ওপর নির্যাতন করেছেন, যাঁরা আপনাদের সঙ্গে অন্যায় করেছেন এবং সর্বোপরি এত কিছুর পরও যারা এতটুকুও বিচলিত হয়নি, তাদের সবার পক্ষ থেকে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি,” খ্রিষ্টীয় ধর্মগুরু ডিসেম্বরের ১ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওই আন্তঃধর্ম সম্মিলনীতে বলেন।
“আমি আপনাদের কাছে প্রার্থনা করছি, আপনাদের হৃদয় সুবিশাল। আপনাদের পক্ষেই আমাদের ক্ষমা করা সম্ভব, যেই ক্ষমা আমরা চাইছি।”
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে এ তথ্য নিশ্চিত করার দুদিন পর বেনারনিউজ মাসুদের সাক্ষাৎকার নেয়। মোহাম্মদ নাসিম জানান, প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে গত নভেম্বরে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অংশ হিসেবে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কয়েকশ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা হবে।
ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে। এই গ্রুপটি স্বেচ্ছায় বাস্তুচ্যুত যেসব মুসলিম রোহিঙ্গা প্রত্যাবসিত হতে চায়, তাদের নিয়ে কাজ করবে।
কিন্তু মৌসুমের মতো শরণার্থীদের অনেকে বলেছেন তাঁদের যদি ফেরত যেতেও হয়, তাঁরা নিরাপদ বোধ করবেন না।
“ফিরে গেলে যে আমাদের ওপর নির্যাতন হবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে? আমাদের ওপর এই সহিংসতা তো বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। হঠাৎ করে মিয়ানমার বলছে যে, আমরা নিরাপদে ফিরতে পারব। এটা বিশ^াস করা সত্যি কঠিন,” মাসুদ বলেন।
প্রত্যাবাসন চুক্তি নিয়ে সংশয়
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি “কুৎসিত অধ্যায়টা বন্ধ করার জন্য মিয়ানমার সরকারের জনসংযোগের চেষ্টা” বলে মনে হয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শরণার্থী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করেন।
“বার্মা এখনো রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর নিপীড়ন বন্ধ করতে পারেনি, নিরাপদে নিজেদের ঘরে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি তো দূরের কথা,” ফ্রেলিক বলেন।
নয়া দিল্লির ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট (আইসিএম) এর অজয় সাহানী ফ্রেলিকের কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। আইসিএম ১৯৯০ সাল থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টির ওপর নজর রাখছে।
“রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা আসলে দেশটির ওপর যে পাহাড়প্রমাণ চাপ তা থেকে বিশে^র দৃষ্টি ফেরানোর একটা কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। রোহিঙ্গারা যেন তাদের নিজ বাসভূমিতে স্থায়ী হতে পারে সে ব্যাপারে কখনই মিয়ানমার দায়িত্বশীল আচরণ করেনি,” সাহানী বেনারনিউজকে বলেন।
এটা ‘প্রায় অসম্ভব’ যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হবে। কারণ ওদের গ্রামগুলোকে জ¦ালিয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে, সাহানী বলছিলেন।
১৯৯২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৫ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে । মিয়ানমার স্টেট কাউন্সিলরের ওয়েবসাইটে এ তথ্য দেওয়া আছে।
“প্রত্যাবাসন এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার পরও রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ হয়নি,” সাহানী বলেন।
অপর একজন বিশ্লেষকের মতে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বড় অংশই হয়তো মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে।
“কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে এবং একই সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেন নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন চাপ অব্যাহত রাখে সে চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে,” জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান বেনারনউিজকে বলেন।
বাংলাদেশের সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, তিনি মনে করেন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হবে।
“১৯৯২ সালের পর থেকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের যে আচরণ তা-ই প্রমাণ করে যে তারা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয়। সর্বসাম্প্রতিক চুক্তিটি তারা করেছে আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে,” বেনারনিউজকে বলেন মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন।
তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আমিন মাসুদ, শ্রীনগর, ভারত।