হত্যা নয়, আত্মহত্যাই করেছেন সালমান শাহ, দাবি পিবিআইর
2020.02.24
ঢাকা

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের নব্বই দশকের ‘সুপারস্টার’ সালমান শাহ ওরফে চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমনকে হত্যার প্রমাণ পায়নি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। দুই যুগ আগে রাজধানীর ইস্কাটন রোডে নিজের বাসায় তিনি আত্মহত্যাই করেছিলেন বলে দাবি করেছে তদন্ত সংস্থাটি।
ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দপ্তরে সোমবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে সংস্থাটির মহাপরিচালক বনজ কুমার মজুমদার জানান, মঙ্গলবার আদালতে ৬০৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন তাঁরা।
“তদন্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, সালমান শাহ খুন হননি; তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটি আত্মহত্যাজনিত,” বলেন তিনি।
এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য থেকে ফোনে বাংলাদেশি নিউজ চ্যানেল সময় টিভিকে সালমানের মা নীলা চৌধুরী বলেন, “সালমান শাহ আত্মহত্যা করেনি, কোনোভাবেই না। আমার কাছে এটা (পিবিআইয়ের সংবাদ সম্মেলন) একটা নাটকের মহড়া মনে হয়েছে।”
তাঁর আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বেনারকে বলেন, “আইনগতভাবে বাদীকে আগে জানানোর কথা। সেটা না করে পিবিআই সাংবাদিক সম্মেলন করেছে। আমরা এটা মেনে নেইনি। আদালতে এ ব্যাপারে আপত্তি জানানো হবে।”
তিনি জানান, পিবিআই প্রতিবেদনের ওপর ১৮ মার্চ শুনানি হবে। তাঁর আগে মামলার বাদী নীলা চৌধুরী দেশে ফিরে এলে সেদিনেই নারাজির আবেদন জানানো হবে। আর তিনি ফিরতে না পারলে আদালতের কাছে সময় চাওয়া হবে।
“কারণ আরজিতে বাদীর স্বাক্ষর লাগবে। হাজির হয়ে আদালতকে জানাতে হবে, কেন তিনি পিবিআইয়ের প্রতিবেদনটি গ্রহণ করতে চান না। এরপর বিচারকই পরবর্তী নির্দেশনা দেবেন,” বলেন ফারুক।
এর আগে ১৯৯৭ সালে সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ এবং ২০১৪ সালে বিচার বিভাগীয় তদন্তে ‘অপমৃত্যু’ বলা হয়। সালমানের মা নীলা সেসব প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করলে ২০১৬ সালে তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।
সালমানের তখনকার স্ত্রী সামিরা হকসহ ৪৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তারা, যাদের মধ্যে ১০ জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
সালমান শাহর প্রথম ও দ্বিতীয় সুরতহাল প্রতিবেদন, ভিসেরা রিপোর্ট, কেমিক্যাল রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ডের মতামত, হস্তলিপি বিশারদদের মতামত, সালমান শাহর বাসায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত, জব্দ করা আলামত, আগের তদন্ত প্রতিবেদন ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কথা জানিয়েছে পিবিআই।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটন রোডে নিজের বাসা থেকে সালমান শাহর লাশ উদ্ধার করা হয়।
আত্মহত্যার পেছনে পাঁচটি কারণ
সালমান শাহ ও চিত্রনায়িকা শাবনূরের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা, স্ত্রী সামিয়ার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ, মাত্রাধিক আবেগপ্রবণতা (যে কারণে আগেও একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা), মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা ও জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমান এবং সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা; আত্মহত্যার পেছনে এই পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছে পিবিআই।
সালমানের বাসার গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগমের জবানবন্দির বরাতে পিবিআই মহাপরিচালক বলেন, “সালমান তাঁর স্ত্রী সামিরা এবং শাবনূর দুজনকেই খুব ভালোবাসতেন। তিনি শাবনূরকেও বিয়ে করে দুই স্ত্রী নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামিরা এতে রাজি হননি।”
সালমানের মায়ের দাবি, এমনটা হলে সামিরা ও শাবনূর, দুজনকেই গ্রেপ্তার করা উচিত।
“আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কীসের জন্য আমার নাম জড়ানো হচ্ছে! সালমান যদি আত্মহত্যাও করে, তাহলে আমার কারণে কেন করবে!” সিডনি থেকে দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন শাবনূর।
উল্লেখ্য, সালমান শাহ-শাবনূর জুটির ১৪টি সিনেমাই বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য পেয়েছিল।
যেভাবে এগিয়েছে মামলাটি
সালমান শাহর মৃত্যুর পর রমনা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন তাঁর বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। পরে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই তিনি হত্যার অভিযোগ তুলে মামলাটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান।
এরই প্রেক্ষিতে অপমৃত্যুর মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগটিও তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেয় আদালত। ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে সিআইডি জানায়, তারা আত্মহত্যার আলামতই পেয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কমরউদ্দিন রিভিশন মামলা করেন।
২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠায় আদালত। এরপর প্রায় ১২ বছর মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে ছিল। এর মধ্যে কমরউদ্দিন মারা গেলে মামলাটি চালিয়ে যান তাঁর স্ত্রী নীলা চৌধুরী।
২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন মহানগর হাকিম ইমদাদুল হক। তাতেও অপমৃত্যুর কথাই বলা হয়।
২০১৫ সালে ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে ‘নারাজি আবেদন’ দাখিল করেন বাদী, আবার রিভিশন আবেদন করেন। আবেদনটি মঞ্জুর করে আদালত প্রথমে র্যাবকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে পিবিআইকে দেওয়া হয় তদন্তভার।
এই তদন্ত চলাকালেই ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিউটিশিয়ান রাবেয়া সুলতানা রুবি ফেইসবুকে প্রকাশ করা ভিডিওতে দাবি করেন, আত্মহত্যা নয়, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন সালমান শাহ এবং তা করিয়েছিল তাঁরই স্ত্রী সামিরা হকের পরিবার। পরে নিজের ওই বক্তব্য অস্বীকার করেন তিনি।
মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরে ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা সালমান শাহ ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ড. মালেকা সায়েন্স ইনস্টিটিউট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন সাবেক ক্রিকেটার শফিকুল হক হীরার মেয়ে সামিরাকে।
ফের আলোচনায় সামলান
মৃত্যুর দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও পিবিআইয়ের সংবাদ সম্মেলনের পর থেকেই সালমান শাহকে নিয়ে ফের আলোচনা শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে।
ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন মামুন বেনারকে বলেন, “সালমান শাহ বাংলাদেশর মানুষের একটি দীর্ঘশ্বাসের কারণ। তাঁর ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতে আসা এবং মর্মান্তিক ও রহস্যজনক মৃত্যু, সবটা এত দ্রুত ঘটেছে যে মানুষের ভিতরে একটা অপূর্ণ বাসনা রয়ে গেছে। যে কারণে তাঁর প্রতি মানুষের আবেগ আজও এত জাগ্রত।”
“নব্বই পরবর্তী সময়ে পুরো বিশ্বে যে ভোক্তা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, বাংলাদেশে তার প্রথম ‘আইকন’ ছিলেন সালমান শাহ,” দাবি করেন এই সংগঠক।