বিজিবি-গ্রামবাসী সংঘর্ষে নিহত ৩, গুলিবিদ্ধ ১৪
2019.02.12
ঢাকা

ঠাকুরগাঁওয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের গুলিতে তিন গ্রামবাসী নিহত ও ১৪ জন আহত হয়েছেন। জেলার হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের বহরমপুর গ্রামে মঙ্গলবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।
“গুলিবিদ্ধ আরও একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁকে মুমূর্ষু অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিরা দিনাজপুরে চিকিৎসা নিচ্ছেন,” বেনারকে বলেন জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।
এসপি জানান, ভারত থেকে চোরাই পথে আনা গরু জব্দ করতে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বিজিবি সদস্যরা। বাহিনীর ঠাকুরগাঁও-৫০ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ সেলিম সাংবাদিকদের বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় আমরা গুলি করতে বাধ্য হই।”
তখন দুই তিনশ লোক ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালায় উল্লেখ করে বিজিবির এই কর্মকর্তা বলেন, “প্রথমে আমরা ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। তাতে আমাদের অস্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন আহত হয়।”
“ঘটনাটি দুঃখজনক,” মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “অনেকে বলেছে বিজিবি সদস্যরা অনেকের ব্যক্তিগত গরুও নিয়ে গেছে। সে কারণেই সংঘর্ষ বেঁধেছে।”
এসপি জানান, বিজিবির সদস্যরা প্রথমে স্থানীয় যাদুরানীর হাট থেকে চারটি গরু জব্দ করে। এরপর তারা বহরমপুর গ্রামের একটি বাড়ি থেকে আরও দুটি গরু জব্দ করতে গেলে সেখানে এলাকাবাসী তাদের বাঁধা দেয়।
তিনি বলেন, “এক পর্যায়ে স্থানীয়রা উত্তেজিত হয়ে ইট-পাটকেল মারা শুরু করলে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ‘ভীত-সন্ত্রস্ত’ হয়ে গুলি চালায় বিজিবি সদস্যরা।”
বিজিবির সদস্যরা জব্দ করা গরুগুলো স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘শ্যালো-ইঞ্জিন’ চালিত ট্রাকে করে নিকটস্থ `বিওপি’-তে (বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট) নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন বলেন, “সবগুলো ভারতীয় গরু, সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিরা নিয়ে এসেছে।”
“সীমান্তের মাত্র দুই কিলোমিটার ভেতরে আমাদের টহল দল তাদের ধরে ফেলে,” যোগ করেন তিনি। এরই জেরে সংঘর্ষকালে বিজিবির গুলিতে ঘটনাস্থলে দুজনের এবং পরে হাসপাতালে আরেকজনের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলেন- বকুয়া ইউনিয়নের রুইয়া গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে নবাব (৩০) ও জহিরুলের ছেলে সাদেক মিয়া (৪০) এবং বহরমপুর গ্রামের নূর ইসলামের ছেলে জয়নাল (১২)।
ব্যবস্থা নেবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “যারা সরকারি আদেশের বাইরে, বাড়ি থেকে চোরাই গরু উদ্ধার করতে গিয়ে গুলি বর্ষণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি জানান, বিজিবির প্রতি সরকারের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোনো গরু কারও বাড়িতে চলে গেলে সেটা যেন উদ্ধার করতে না যায়।
“কিন্তু বিজিবি সদস্যরা পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে এসে বাড়িতে ঢুকে গরু নিতে গিয়েছে। ফলে জনগণ বাধা দিয়েছে,” বলেন মন্ত্রী।
“সংঘর্ষের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে বিজিবি সদস্যরা সেখান থেকে চলে যায়,” বেনারকে বলেন হরিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিরুজ্জামান।
নিহতরা চোরাকারবারি নয়
বকুয়ার ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বর্ষা বেনারকে জানান, নিহতরা চোরাকারবারি নয়। তাদের মধ্যে দুজন সাধারণ পথচারী, হাটে যাচ্ছিল। আরেকজন স্কুল শিক্ষার্থী।
তাঁকে সমর্থন করে এসপি বলেন, “ঘটনাস্থলের পাশেই ছিল হাটে যাওয়ার প্রধান রাস্তা। যে কারণে অনেক সাধারণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছে।”
তবে ওসি আমিরুজ্জামানের অভিমত, “যেহেতু সীমান্ত এলাকা, সেহেতু তদন্তের আগে কাউকে সাধারণ মানুষ ভাবা ঠিক নয়।” এলাকাটি চোরাকারবারি অধ্যুষিত বলেও তিনি দাবি করেন।
প্রসঙ্গত, ঠাকুরগাঁও জেলায় মোট ১৬২.৬৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি
খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান সেলিমও দুপুরেই ঘটনাস্থলে পৌঁছান।
এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জানিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “কমিটির প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” বহরমপুর গ্রামের জনগণকে শান্ত করতে সন্ধ্যা অবধি সেখানে ছিলেন ডিসি ও এসপি।
পরে হরিপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম জে আরিফ বেগ এবং ওসি আমিরুজ্জামানকে ঘটনাস্থলে অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে তারা ফিরে যান।
রাতে ইউপি চেয়ারম্যান বর্ষা জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
মৃত্যুর ফাঁদ গরুর কারবার
এ ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বিজিবির ঠাকুরগাঁও সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সামসুল আরেফিন বলেন, “বেশ কিছুদিন ধরে সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাওয়ায় চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশের ব্যাপারে বিজিবি কঠোর অবস্থান নিয়েছে।”
সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন জেলার সীমান্তে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) গুলিতে নিহত হয়েছেন পাঁচজন। নিহতদের মধ্যে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরও রয়েছে। এদের প্রত্যেকেই গরু পারাপারকালে নিহত হয়েছেন বলে দাবি করে আসছে বিএসএফ।
ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার জগদল সীমান্তে গত ২৮ জানুয়ারি বাবু (১৪) নামের এক কিশোর নিহত হয়। একই উপজেলার ধর্মগড় সীমান্তে ১৮ জানুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জাহাঙ্গীর আলম (২১)।
হরিপুর উপজেলার মিনাপুর সীমান্তে ২১ জানুয়ারি মো. জেনারুল হক (২২) এবং ২৪ জানুয়ারি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর চর আষাড়িয়াদহ সীমান্তে নিহত হন জামাল (৪৫)।
সর্বশেষ লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলা সীমান্তে ২ ফেব্রুয়ারি আসাদুল হক (৩০) মারা যান ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।