খাগড়াছড়িতে গ্রামবাসীর সাথে সংঘর্ষে বিজিবি সদস্যসহ নিহত ৫

শরীফ খিয়াম
2020.03.03
ঢাকা
200303_Villagers_BGB_Khagrachari_1000.jpg খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা পৌরসভার গাজীনগর গ্রামে বিজিবির সাথে গ্রামবাসীর সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হবার পর ঘটনাস্থলে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলছেন সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সদস্যরা। ৩ মার্চ ২০২০।
[বেনারনিউজ]

খাগড়াছড়িতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) এক সদস্যসহ পাঁচজন নিহত এবং কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছেন। পার্বত্য জেলাটির মাটিরাঙ্গা পৌরসভার গাজীনগর গ্রামে মঙ্গলবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।

জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আবদুল আজিজ এ তথ্য নিশ্চিত করেন। ঘটনাস্থল থেকে ফিরে তিনি বেনারকে বলেন, “তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটন করে এ ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই বিচার করা হবে; এমনটা বলে আমরা সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করে সেখানকার পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি।”

সেখানে শত শত মানুষ বিজিবি বিরোধী বিক্ষোভ করছিলেন জানিয়ে এসপি বলেন, “বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।”

এ ঘটনায় নিহতরা হলেন বিজিবির সদস্য মোহাম্মদ শাওন (৩০), গাজীনগর গ্রামের মো. সাহাব ওরফে মুসা মিয়া (৬০), তাঁর দুই ছেলে আহম্মদ আলী (২৫) ও আলী আকবর (২৭) এবং একই গ্রামের মফিজ মিয়া (৫০)।

সংঘর্ষে স্বামী ও ছেলেদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে হার্ট অ্যাটাকে মুসা মিয়ার ‍স্ত্রী রঞ্জু বেগমও মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন মাটিরাঙ্গা পৌরসভার চেয়ারম্যান মো. শামছুল হক।

তিনি বেনারকে বলেন, “সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কোনোভাবেই এই ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না এলাকাবাসী। প্রশাসনের পাশাপাশি আমরা তাঁদের শান্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

কাঠ নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে বিজিবির সাথে গাজীনগর গ্রামের মুসা মিয়ার পরিবারের বাকবিতণ্ডা থেকে হতাহতের ঘটনাটি ঘটেছে বলে বেনারকে জানান মাটিরাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামসুদ্দিন ভুঁইয়া।

“মুসা মিয়া আর তাঁর ছেলেরা যখন কাঠ নিয়ে যাচ্ছিল তখন বিজিবি তাঁদের বাঁধা দেয়। কাঠ কোথায় যাচ্ছে জানতে চেয়ে তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চায়। এ নিয়ে দুই পক্ষের বাকবিতণ্ডা হাতাহাতিতে গড়ালে একপর্যায়ে গুলি ছোড়ে বিজিবি। ততক্ষণে সেখানে আরও গ্রামবাসী জড়ো হয়ে যাওয়ায় সংঘর্ষ আরও বড় আকার ধারণ করে,” বলেন ওসি।

তিনি জানান, সংঘর্ষে গুরুতর আহত মো. হানিফকে (২৮) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং অন্যান্যদের খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ও মাটিরাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে ‘অবৈধ কাঠ পাচার’ রোধ করতে গেলে স্থানীয় লোকজন বিজিবির অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে গুলিবর্ষণ করায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দাবি করেছে বিজিবি।

বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামের পাঠানো ওই বিবৃতিতে বলা হয়, “গাজীনগর বাজার হতে ১০০ গজ দক্ষিণে বিজিবির একটি টহল দল অবৈধ কাঠ পাচার রোধে ব্যবস্থা নিলে বেসামরিক স্থানীয় লোকজন বিজিবি টহল দলকে ঘিরে ধরে। এতে বিজিবি টহল দল ও বেসামরিক জনগণের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।”

ওই পরিস্থিতিতে বিজিবির এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও ধাক্কাধাক্কির রেশ ধরে বেসামরিক লোকজন অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গুলি বর্ষণ শুরু করে। এর ফলে মোট ছয়জন গুলিবিদ্ধ হন বলে উল্লেখ করা হয় ওই বিবৃতিতে।

এদিকে মৃতদেহগুলোর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে সেগুলো হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে বেনারকে জানান এসপি।

তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সন্দেহ থেকে সূত্রপাত

পাহাড়ে যেকোনো গাছ কেটে কিছু করতে হলে বন বিভাগের অনুমতি লাগে উল্লেখ করে ওসি শামসুদ্দিন বেনারকে বলেন, “কেটে আনা গাছগুলোকে অবৈধ চোরাই কাঠ মনে করেছিলেন বিজিবির সদস্যরা। যে কারণে তাঁরা সেগুলো জব্দ করতে চেয়েছিলেন।”

“শুনেছি যারা গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁদের সেই অনুমতি ছিল না,” বেনারকে বলেন গাজীনগরের পাশ্ববর্তী গোমতী ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. বিল্লাল হোসেন।

এর আগে গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলায় ‘চোরাই সন্দেহে’ গরু জব্দ করতে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল বিজিবি। সেবার তাদের গুলিতে তিন গ্রামবাসী নিহত ও ১৪ জন আহত হয়েছিলেন।

নেপথ্যে চোরাকারবার

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদের দাবি, খাগড়াছড়ি বা ঠাকুরগাঁওয়ের মতো সবগুলো ঘটনার পেছনে চোরাকারবারি চক্রের হাত রয়েছে। তারা নিরাপত্তা বাহিনীকে কিছুটা অকেজো করার জন্য এই কৌশলটি অহরহই ব্যবহার করে।

“বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, এ জাতীয় সংঘর্ষগুলোর পেছনে তাদের উসকানি ও পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। তারা যখন বাধা পায় তখনই নানাভাবে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে তোলে। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীকে আরও সতর্ক হতে হবে,” বেনারকে বলেন তিনি।

এ জাতীয় সংঘর্ষ এড়াতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া উচিত উল্লেখ করে আব্দুর রশীদ বলেন, “জনগণের ইচ্ছার সাথে তাল মিলিয়ে বিজিবিকে তার দায়িত্বে ছাড় দিতে হবে কি হবে না সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিরীহ মানুষের মৃত্যু কখনোই কাম্য নয়।”
পাহাড়ে কেউ গাছ কাটতে শুধু নয়, পরিবহন করতে চাইলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনুমতি নিতে হয় বলে জানান সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।