বাংলাদেশি আদিবাসীদের অভিবাসনে প্রলুব্ধ করছে মিয়ানমার
2018.04.23
বান্দরবান

মিয়ানমারের নির্যাতন থেকে বাঁচতে যখন হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে, ঠিক তখন দেশটির আর্থিক ও নাগরিকত্বের প্রলোভনে কিছু আদিবাসী মানুষ উল্টোদিকে পাড়ি জমাচ্ছেন।
কৃষি প্রধান রাখাইনে রোহিঙ্গাদের শূন্যস্থান পূরণ করে বৌদ্ধদের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পরিচালিত ‘না টা লা প্রকল্পের’ বিষয়ে অবগত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত মিয়ানমার সরকারের সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।
এদিকে সম্প্রতি বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়ন থেকে অন্তত ৩৫টি আদিবাসী পরিবার ইতিমধ্যেই মিয়ানমার চলে গেছে বলে বেনারকে জানান স্থানীয়রা।
এ প্রসঙ্গে রারাইপাড়া গ্রামের প্রেংলুং ম্রো বেনারকে বলেন, “গত বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মাঝে কুরুপাতা থেকে ৩৫টি ম্রো পরিবার বার্মা চলে গেছে। যাবার আগে তারা আমাদের বলেছে, ওখানে তারা ফ্রি চাল, জমি, বাড়ি, গরু এমনকি নাগরিকত্বও পাবে।”
উন্নত জীবনের প্রলোভন
বাংলাদেশে নিজেদের আর্থিক দুরবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে রারাইপাড়া অধিবাসী লিমওয়াই ম্রো বেনারকে জানান, এখানে বাঙালি দাদনদাররা তাঁদের মতো দরিদ্র মানুষদের কাছে টাকা ধার দেয়।
“কিন্তু ফেরত দেয়ার সময় দ্বিগুণ দিতে হয়। এক টাকা নিলে ছয় মাস পরে দুই টাকা দিতে হয়। এক হাজার টাকা নিলে দুই হাজার টাকা দিতে হয়। এজন্য দেনায় পড়ে অনেকে মিয়ানমার চলে যাচ্ছে,” বলেন লিমওয়াই।
পাহাড়ি জনগণ তাঁদের উৎপাদিত পণ্য যেমন হলুদ, আদা, আম, আনারস, ইত্যাদির নায্যমূল্য পায় না বলেও জানান তিনি। একই সাথে পাহাড়ে চালের ফলনও কমে এসেছে বলে তিনি জানান।
“বর্মায় তো সব কিছু ফ্রি। কারবারিরা টাকা দেয়, সরকার টাকা দেয়,” বলেন লিমওয়াই ম্রো।
এই আর্থিক লোভের কারণে মিয়ানমার অভিবাসন অনেকের কাছে আকর্ষণীয় হলেও একটি পরিবারের কাছে তা গত মাসে হয়ে উঠেছিল আতঙ্কের কারণ।
বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পাড়ি দেবার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পোঁতা স্থল মাইনে গত মার্চের ১৪ তারিখ পাওয়াই ম্রো মারা যাবার পর তাঁর পরিবার আবার আলিকদম ফিরে আসে।
আর্থিক সচ্ছলতার লোভেই তাঁর স্বামী মিয়ানমার পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছিলেন বলে বেনারকে জানান পাওয়াই ম্রোর বিধবা স্ত্রী সংরো ম্রো।
তিনি বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের নাগরিক অং সান নামের এক ম্রো আমার স্বামীকে সেখানে যেতে লোভ দেখিয়েছে। এখানে আমাদের সংসার চলছিল না”
অং সান নিজেও এক সময় আলীকদমের বাসিন্দা ছিল জানিয়ে সংরো ম্রো বলেন, “সে আমার স্বামীকে বলেছে, রাখাইন যেতে পারলে সরকারিভাবে পরিবারের সবার জন্য চাল, জমি, গরু দিত।”
স্থল মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতের দাগ মুখে নিয়ে সংরো ম্রো বলেন, “সে বলেছে প্রথম দুবছর আমাদের রাখাইনে ক্যাম্পে থাকতে হতো। এরপর থাকার বাড়িঘর দেয়া হতো। এরপর আমরা বার্মার নাগরিক হয়ে যেতাম।”
“এখানে দারিদ্র আছে তবে সহিংসতা নেই। আমি আর কখনো বর্মা যাব না,” যোগ করেন সংরো।
এদিকে চারটি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মিয়ানমারে পাড়ি জমাচ্ছে বলে বেনারকে জানান বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি, সীমান্তের ওপার থেকে প্রলোভন দেখানো হচ্ছে, ওখানে জমি দেবে, গরু দেবে, ছাগল দেবে, ফ্রি খাবার দেবে। এরকম প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের ওপারে নেয়ার চেষ্টা করছে।”
“এসব প্রলোভনে পড়ে থানচির রেমাক্রির সাঙ্গু রিজার্ভে যারা থাকত সেসকল ম্রো পরিবার মিয়ানমার চলে গেছে। তাছাড়া, মারমা, ত্রিপুরা, মোদকরা মিয়ানমার চলে গেছে। আমরা জানতে পেরেছি, আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা থেকে ম্রোরা চলে যাচ্ছে,” বলেন ক্য শৈ হ্লা।
“সেই সংখ্যা ৩৫ বা তার বেশি পরিবারও হতে পারে,” যোগ করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, এই চারটি আদিবাসীর মধ্যে মারমারা বৌদ্ধ ধর্মবলম্বী, ত্রিপুরা ও মোদকরা হিন্দু এবং ম্রোরা প্রকৃতি পূজারি হলেও তাঁদের জীবন-যাপনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব রয়েছে।
চারটি আদিবাসীরই বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে।
ক্য শৈ হ্লা বলেন, “বিষয়টি জানতে পেরে আমাদের বিজিবি, জনপ্রতিনিধিরা সবাই তাঁদের যাওয়া বন্ধ করার ব্যবস্থা নিয়েছি। বিজিবি সীমান্তে টহল বাড়িয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত।”
তবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দুর্গম এলাকায় টহল দেয়া বিজিবির পক্ষে কঠিন ব্যাপার বলেও জানান ক্য শৈ হ্লা।
বাংলাদেশ অবগত
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে জানান, তিনি বান্দরবান জেলা থেকে 'উপজাতি' গোষ্ঠীর সদস্যদের মিয়ানমার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে অবগত।
তিনি বেনারকে বলেন, “সঠিক সংখ্যা বলতে পারব না। তবে কিছু বৌদ্ধ পরিবার সেখানে চলে গেছে। আবার কিছু পরিবার ফিরেও এসেছে। কারণ সেখানে তাঁরা আমাদের এখানকার মতো স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে না।”
এদিকে মিয়ানমার সরকার ১৯৯০ এর দশক থেকে বিভিন্ন প্রদেশে না টা লা নামক পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলে বেনারকে জানান মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনজুরুল করিম খান চৌধুরী।
“রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে মিয়ানমার সরকার না টা লা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে,” বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের চলে আসার পর রাখাইনের অর্থনীতি কার্যত ভেঙে পড়েছে। কাজেই তাঁদের জমি চাষ করতে হলে মানুষ প্রয়োজন। আর সেজন্য বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাঁদের পছন্দ।”