বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী পাচারের রুট: মার্কিন সরকারি প্রতিবেদন

প্রাপ্তি রহমান
2017.11.17
ঢাকা
ঢাকার হযরত শাহাজালাল বিমানবন্দর থেকে পাচারের সময় বাংলাদেশ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ৪১৫টি কচ্ছপ আটক করে। ঢাকার হযরত শাহাজালাল বিমানবন্দর থেকে পাচারের সময় বাংলাদেশ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ৪১৫টি কচ্ছপ আটক করে। ছবিটি বন অধিদপ্তর শেরেবাংলানগর, আগারগাঁও থেকে তোলা। ১৭ এপ্রিল ২০১২।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

মাত্র কয়েক দিন আগে ভারতে পাচারের সময় যশোরের বেনাপোল সীমান্ত থেকে এক জোড়া সিংহের বাচ্চা ও একটি চিতাবাঘের বাচ্চা উদ্ধার হয়। এই ঘটনার রেশ না মেলাতেই এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নাম এসেছে বিশ্বে বন্যপ্রাণী পাচারের অন্যতম উৎস ও ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে।

বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কংগ্রেসে তাদের এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। ‘এন্ড ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাফিকিং’ নামের প্রতিবেদনটিতে বন্যপ্রাণী পাচারের সঙ্গে যুক্ত আছে, এমন দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিশেষ উদ্বেগজনক অবস্থায় থাকা দেশগুলোরও একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ ২৫টি দেশ বন্যপ্রাণী পাচারের উৎস ও ট্রানজিট পয়েন্টই শুধু নয়, দেশগুলোয় বন্যপ্রাণীজাত বিভিন্ন পণ্য ব্যবহৃত ও পাচার হয়ে থাকে।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচারের (আইইউসিএন) এ দেশীয় পরিচালক ইশতিয়াক উদ্দীন আহমেদ বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রাণীর পাচার হয়ে যাওয়া বা পাচারের একটি রুট হিসেবে বাংলাদেশের ব্যবহার হওয়া, দুটোই উদ্বেগের।

ইশতিয়াক উদ্দীন আরও বলেন, “মাত্র দিন তিনেক আগে আমরা দেখেছি দুটি সিংহ শাবক ও একটি চিতা বাঘের বাচ্চা বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছিল। এই প্রাণী দুটির কোনোটিই বাংলাদেশের নয়। তার মানে বাংলাদেশ এখানে রুট হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। এর আগেও আমরা এ দেশীয় প্রাণীর চামড়া, কচ্ছপ, পাখি, সরীসৃপ পাচার হতে দেখেছি। এর মানে দু’ভাবেই বাংলাদেশ ব্যবহার হচ্ছে।”

“কিন্তু সবাইকে মাথায় রাখতে হবে প্রাণী প্রকৃতির সম্পদ। পাচার হওয়ার অর্থ, এসব প্রাণী আর প্রকৃতিতে ফিরছে না,” বলেন ইশতিয়াক।

আইইউসিএনের পর্যবেক্ষণ হলো, বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও খুব গভীরে গিয়ে কেউ তদন্ত করে দেখছে না পাচার হওয়া প্রাণীগুলো কোথায় যাচ্ছে। তারা মনে করে, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা থেকে ভারতে এবং বান্দরবান থেকে ভারত ও মিয়ানমারে পাচারের ঘটনা ঘটছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই প্রতিবেদনে স্থান পাওয়া ২৫টি দেশের তালিকায় ভারত ও মিয়ানমারের নামও রয়েছে।

পররাষ্ট্র দপ্তর প্রতিবেদনটি তৈরিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা সাইটস (কনভেনশন অফ দ্য ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেনজারড স্পেশিস অফ ওয়াইল্ড ফনা অ্যান্ড ফ্লোরা), আইইউসিএন, ইউএন অফিস অফ ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি), সেন্টার ফর ‌অ্যাডভান্স ডিফেন্স স্টাডিজ, ট্রাফিক অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতা নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করে।

পাচার সম্পর্কে যত দূর জানা যায়

২০১২ সালে রাজধানীর শ্যামলী থেকে র‌্যাব দু মাস বয়সী তিনটি বাঘের ছানা উদ্ধার করে। পাচারকারী হিসেবে শনাক্ত হন আবদুল কাদের। আবদুল কাদেরের ছেলে জাকির হোসেন সে সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, একজন বন কর্মকর্তার নির্দেশে তাঁর বাবা ওই বাঘের বাচ্চাগুলো সুন্দরবন থেকে এনেছেন। এর আগেও তাঁর বাবা ওই বন কর্মকর্তাকে কুমির, ঘড়িয়াল ও পাইথন এনে দিয়েছেন। রাজধানী ঢাকা থেকে পাচারের উদ্দেশে আনা বাঘ উদ্ধারের ঘটনা সেটিই ছিল প্রথম।

বন বিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের হিসাবে জুন ২০১২ থেকে নভেম্বর ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৩৯টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯ হাজার ৩৫৯টি সরীসৃপ ও ১৬ হাজার ৯৭৯টি পাখি উদ্ধার হয়।

তা ছাড়া বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাঘ, বাঘের চামড়া, হাড় ও দাঁত, হরিণের চামড়া এবং হাতির দাঁত উদ্ধার করে। বড় সংখ্যায় উদ্ধার হয়েছে কচ্ছপও।

বন কর্মকর্তা মো. জাহিদুল কবীর বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক ভিত্তিতে বন্যপ্রাণী পাচার হচ্ছে, এমন কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। তবে কিছু কিছু যে হচ্ছে না, তা বলা যাবে না। তিনি বলেন, “এর আগে তিনটি বাঘের বাচ্চা বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার হয়েছিল। তবে সেগুলো সংঘবদ্ধ কোনো চক্রের কাজ ছিল কি না, সে সম্পর্কে জানা যায়নি। এবার যে সিংহ ও চিতা ধরা পড়েছে, সেগুলোও আমাদের নয়। পাচারের অন্যতম কারণ হচ্ছে, বন্যপ্রাণী ও প্রাণীজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা।”

জাহিদুল কবীর জানান, পাচার হওয়া প্রাণীর গন্তব্যস্থল প্রধানত চীন। এর বাইরে পূর্ব এশিয়ার দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে পাচারের খবরও পাওয়া যায়।

কেমন আছে সিংহশাবক ও চিতা

যশোরের বেনাপোল থেকে উদ্ধার করা সিংহ শাবক ও চিতার বাচ্চা এখন থেকে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হযেছে। বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ মোতালেব হোসেন বেনারকে বলেন, তাঁরা ধারণা করছেন এই প্রাণীগুলো এসেছে আফ্রিকা থেকে।

তিনি বলেন, “ওরা এখন আমাদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে আছে। আমরা ওদের কিছুটা কাহিল অবস্থায় পেয়েছিলাম। কত দূর থেকে ওরা এসেছে সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। তবে এটা ঠিক ওরা খাওয়া-দাওয়ার কষ্টে পড়েছিল। ওদের দুধ খাওয়ার বয়স চলে গেছে, ওরা এখন মাংস খায়।"

এই ঘটনায় যশোরের পুলিশ দুজনকে আটক করে কারাগারে পাঠিয়েছে। ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের তথ্য মতে, বন্যপ্রাণী পাচারের ঘটনায় গত পাঁচ বছরে প্রায় ৫০০ লোককে আটক করা হয়েছে। কিন্তু এরা সবাই ছিলেন বাহক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুসন্ধান ও তদন্ত ছাড়া বন্য প্রাণী পাচারে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্রকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।