ক্রিকেট যুদ্ধ রূপ নিল বাকযুদ্ধে, আইসিসি সভাপতির পদত্যাগ
2015.04.01

“দেশে ফিরেই সব বলব,”—আ হ ম মুস্তফা কামাল এমন ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে শোনার অপেক্ষায় ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। ৩১ মার্চ দেশে ফিরেই তিনি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার কথা শোনালেন।
গত ১৯ মার্চ ভারতের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে বাংলাদেশ ‘বিতর্কিত’ আম্পায়ারিংয়ের শিকার হওয়া এবং ২৯ মার্চ ফাইনালে বিজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের হাতে বিশ্বকাপের ট্রফি তুলে দিতে মুস্তফা কামালকে বিরত রাখার ঘটনায় দেশজুড়ে ক্ষোভ আর সমালোচনা হচ্ছে।
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে কোয়ার্টার-ফাইনালের ওই খেলায় ভারতের কাছে ১০৯ রানে হারে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে রুবেল হোসেনের ‘নো’ বল আর মাহমুদুল্লাহর আউট নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
‘নো’ কল্যাণে বেঁচে যাওয়া রোহিত শর্মার শতকে বাংলাদেশকে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে পৌঁছায় ভারত। এ নিয়ে বাংলাদেশে ক্রিকেটভক্তদের চোখেমুখে এখনও রয়েছে বিষাদের ছায়া।
তবে এ নিয়ে প্রতিবেশি দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে পারষ্পরিক বিরোধ নেই। খেলায় হেরে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ মূলত আইসিসির বিরুদ্ধে।
আর মুস্তফা কামালকে বাদ দিয়ে বিশ্বকাপের ট্রফি চ্যাম্পিয়নের হাতে তুলে দেওয়ায় নিন্দা ও সমালোচনা এন শ্রীনিবাসনকে ঘিরে।
এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশ ছাড়াও তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছিল বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটভক্তদের মধ্যে এবং বিশ্ব গণমাধ্যমে। আনন্দবাজারসহ কয়েকটি ভারতীয় গণমাধ্যমে শ্রীনিবাসনের এই ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
“বাংলাদেশ ক্রিকেটমহল তাদের দেশের আইসিসি প্রেসিডেন্টকে পুরস্কার বিতরণ থেকে কার্যত সাসপেন্ড করায় অত্যন্ত উত্তেজিত। কারণ আইসিসি-র গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিশ্বকাপ তুলে দেওয়ার কথা কামালের,” ৩০ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে একথা বলা হয়।
আনন্দবাজার প্রশ্ন তুলেছে, “মুস্তাফা কামালের আম্পায়ারিং নিয়ে মন্তব্য করা অত্যন্ত অসমীচীন হয়েছে এটা যারা মনে করেন তাদেরও বক্তব্য, আইসিসি কেন তা হলে ওকে শোকজ করল না? বেসরকারি বৈঠক করে এ ভাবে তাঁকে বাদ দেওয়াটা তো বেআইনি? সেই দাদাগিরি ভারত করবে কেন? আর তাদের করতে দেওয়াই বা হবে কেন?”
এ প্রসঙ্গে আবারও উঠে এসেছে, আইপিএল স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির পর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির পদ থেকে পদচ্যুত হয়েছিলেন শ্রীনিবাসন। কিন্তু তিনিই পরবর্তীতে আইসিসির চেয়ারম্যান হন।
আইসিসির কর্মকাণ্ড ও নিজের অবস্থান নিয়ে দেশে ফিরেই বিমান বন্দরে কথা কথা বলেন আইসিসি সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল। হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে দুপুর একটায় তিনি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। “১৬ কোটি মানুষকে ‘ছোট’ করে এ পদে থাকতে চাই না,” জানালেন মুস্তফা কামাল, যিনি বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী। আগামী জুনে সভাপতি পদে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
“আইসিসির ৩.৩ ধারা অনুযায়ী, বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের শিরোপা তুলে দেওয়ার দায়িত্ব সভাপতির। এ দায়িত্বের বিচ্যুতি ঘটার সুযোগ নেই। সে হিসেবে ২৯ মার্চ ট্রফি দেওয়ার কথা ছিল আমার। কেন দিতে পারিনি, তা আপনারা জানেন,” ক্ষোভের সঙ্গে জানান মুস্তফা কামাল।
সেদিন আগে-পরে কী ঘটেছিল তা সবিস্তারে বর্ণনা দেন কামাল। তিনি তুলে ধরেন ১৯ মার্চ বাংলাদেশ-ভারত কোয়ার্টার ফাইনালের বিভিন্ন ঘটনা।
“সেদিন মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) স্পাইডার ক্যামেরা ছিল না। বিশ্বকাপে এই প্রথম দেখালাম এমসিজিতে স্পাইডার ক্যামেরা নেই। এছাড়া এ ধরনের টুর্নামেন্টে বড় পর্দার মালিক আইসিসি। অথচ সেদিন বড় পর্দায় লেখা উঠল ‘‘জিতেগা ভাই জিতেগা ইন্ডিয়া জিতেগা,” এটার মানে কী?” প্রশ্ন তোলেন আইসিসির সভাপতি।
মুস্তফা কামাল জানান, “ম্যাচ চলাকালীন আইসিসির কমার্শিয়াল ম্যানেজারকে বলি বিজ্ঞাপনটা নামাতে। তবু সেটি নামানো হয়নি।”
সংবাদ সম্মেলনে মুস্তাফা কামাল অভিযোগ করেন, এরপর একের পর এক সিদ্ধান্ত দেওয়া হলো বাংলাদেশের বিপক্ষে। সেদিন প্রযুক্তির ব্যবহারও ঠিকমতো হয়নি। আম্পায়াররা ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে, তা বলছি না। মানুষ হিসেবে তাদের ভুল হতেই পারে। তাঁর প্রশ্ন—কিন্তু প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার কেন হবে না?
উল্লেখ্য, ওই ম্যাচের পরই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন কামাল। সে প্রসঙ্গে গতকাল তিনি বললেন, “আমি যেমন আইসিসি সভাপতি, তেমনি একজন মানুষ, ক্রিকেটপ্রেমী। আমার কাছে আইসিসি সভাপতির চেয়ে দেশ আগে।”
ফাইনালে কেন তিনি ট্রফি দিতে পারেননি, এর ব্যাখ্যা হিসেবে বললেন, “ফাইনালের আগে আমাদের একটা অনানুষ্ঠানিক সভা হয়েছিল। সেখানে শ্রীনিবাসন ছিলেন। আমাকে বললেন, আমার বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে নতুবা বিবৃতি প্রত্যাহার করতে হবে।”
“আমি বললাম, ১৬ কোটি মানুষের জন্য এমন বিবৃতি দিয়েছি। তাদের বাদ দিয়ে এটা প্রত্যাহার করতে পারব না। তিনি তখন বললেন, তাহলে আপনি ট্রফি দিতে পারবেন না। বললাম, সংবিধান অনুযায়ী সভাপতি ছাড়া ট্রফি দেওয়ার এখতিয়ার কারও নেই,” জানান মুস্তফা কামাল।
উল্লেখ্য, আইসিসির সংবিধান পরিবর্তন করতে চাইলেও পূর্ণ ১০ সদস্যের মধ্যে ৮ সদস্যের সম্মতি লাগে। এরপর বার্ষিক সভায় সেটা ওঠাতে হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করারও কথা সভাপতি হিসেবে মুস্তফা কামালের।
মুস্তফা কামাল সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার পর আইসিসির চেয়্যারম্যান শ্রীনিবাসনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ আরো প্রকাশ্য হয়ে পড়ল। শ্রীনিবাসন দেশে ফিরে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলেননি। কিন্তু মুস্তফা কামাল সব তুলে ধরলেন দেশী–বিদেশী গণমাধ্যমের কাছে।
আইপিএল স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির পর বারবার বিতর্কে জড়িয়েছে শ্রীনিবাসনের নাম।
“মেলবোর্নে তাঁকে দেখা মাত্রই গ্যালারি থেকে সেদিন ভেসে আসে তীব্র বিদ্রূপ। তাঁর নাম উচ্চারণ হতেই গ্যালারি থেকে ‘মানি না, মানি না’ ধিক্কার ভেসে এল,” জানান মুস্তফা কামাল।
“এরপর শচীন টেন্ডুলকার তাঁকে রক্ষা করেন। টেন্ডুলকারের নাম উচ্চারণ হতেই সেটি থামে। যে মানুষটি নিজের দেশে বিতর্কিত, ক্রিকেটে বিতর্কিত, তিনি কিনা আইসিসির দায়িত্বে,” ক্ষোভের সঙ্গে জানান মুস্তফা কামাল।
পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, “এখন থেকে আমি সাবেক সভাপতি। যারা অসাংবিধানিক ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না, তাদের সঙ্গে আমি কাজ করতে পারি না। ”
এর আগে ভারতের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে বাংলাদেশ ‘বিতর্কিত’ আম্পায়ারিংয়ের শিকার হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলে (আইসিসি) আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।
সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বাজে আম্পায়ারিংয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে আইসিসির কাছে আপিল করার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন।
“বিসিবি যেন বাজে আম্পায়ারিংয়ের বিরুদ্ধে আইসিসিতে আপিল করে, সে জন্য ৩০ মার্চ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ম্যানেজার, ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ও ক্রীড়া সচিবকে আমি নোটিশ দিয়েছি, বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. ইউনুস আলী আকন্দ।
নোটিশে তিনি দাবি করেছেন, আম্পায়ারদের শাস্তির পাশাপাশি আইসিসির কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে হবে।
আইসিসির আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তাই আইসিসিতে ভারতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ভারতের আছে ১২৫ কোটি জনগণ। ক্রিকেট বিশ্বের অন্যান্য সব দেশ মিলিয়েও এত জনগণ হবে না।
“অর্থ উপার্জনের জন্য আইসিসির সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপের শুরুতেই ভারত বাদ মানে, আইসিসির বিরাট লোকসান। ভারতকে যত দূর পর্যন্ত নেওয়া যাবে, আইসিসির আয়ও তত বাড়বে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রংপুর শহরের সবুজ লাইব্রেরীর মালিক শাহরিয়ার খান।