হাজারীবাগের ট্যানারি সরাতে কঠোর অবস্থানে সরকার
2016.01.14

রাজধানী ও আশপাশের পরিবেশ রক্ষায় হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো না সরালে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বাতিলসহ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া শিল্প প্লট বাতিল করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
এরই অংশ হিসেবে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষে বৃহস্পতিবার শিল্প মন্ত্রণালয় ২৮টি ট্যানারি প্রতিষ্ঠানকে আইনি নোটিশ দিয়েছে।
হাজারিবাগের এই ট্যানারিগুলোর কারণে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা ও নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যাসহ বিভিন্ন নদী মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে নদীর মাছ, জলজপ্রাণি ও জনস্বাস্থ্যসহ সামগ্রিক পরিবেশের ওপর।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, হাজারীবাগের পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে বিদেশি ক্রেতারা এখন আর কার্যাদেশ দিচ্ছেন না। চামড়া রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থায় নিজেদের স্বার্থেই ওখান থেকে দ্রুত ট্যানারি স্থানান্তরে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ দেখানো উচিত।
গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তার আগে সাভারে প্রত্যেক ট্যানারি মালিকের নামে প্লট বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।
মোট ১৫৫ জন শিল্পোদ্যোক্তার মাঝে ২০৫টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রায় এক শ উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে তাঁদের শিল্প সাভারে স্থানান্তর করেছেন।
মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে মালিকদের জন্য বিশেষ ব্যাংকিং সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ পেয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে রাস্তাঘাটসহ সব ধরনের অবকাঠামো। সরকারি অর্থায়নেই কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি উদ্যোগে সাভারে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা হলেও ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন পর্যন্ত সেখানে যেতে চান না। এই পরিপ্রেক্ষিতে হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্প কারখানাগুলো সাভারে সরাতে মালিকদের ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়, যা শেষ হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার।
“সরকারের নির্দেশনা না মানলে সরকার আইনি পথেই হাঁটবে,” বেনারকে জানান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ।
নোটিশ দিলেও কাজ না হলে সরকার কী করবে—এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, নির্দেশ অমান্য করা ট্যানারির লাইসেন্স বাতিল করার পাশাপাশি সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে তাদের প্লটও বাতিল করা হবে।
ক্ষুব্ধ মন্ত্রী জানান, প্রয়োজনে সাভারের ট্যানারি শিল্পনগরে বরাদ্দ করা প্লট নতুন উদ্যোক্তাদের দেওয়া হবে। তার আগে হাজারীবাগের কারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।
এ পরিস্থিতিতে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি উচ্ছেদ করা হবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে আমু বলেন, “যেহেতু এটা আইনি প্রক্রিয়ার ব্যাপার, সেহেতু নোটিশের মাধ্যমেই তা করতে হবে। হুট করে করা যাবে না।”
তিনি আরও বলেন, “বেশির ভাগ ট্যানারি মালিকের সাভারে প্লট আছে, নির্দেশ না মানলে তা বাতিল করা হবে। প্লট বরাদ্দ পাওয়ার জন্য বহু ব্যবসায়ী অপেক্ষা করছে, প্রয়োজনে তাদেরকে দিয়ে দেব।”
সরকার ও ট্যানারি সংগঠনগুলোর সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হাজারীবাগের সব ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর হওয়ার কথা ছিল। এরপর আরও দুই দফা সময় বাড়িয়ে ট্যানারি স্থানান্তরের সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর করা হয়।
শিল্পমন্ত্রী বলেন, “এটি ছেলে খেলার বিষয় নয়। ট্যানারি শিল্প মালিকেরা সরকারের কাছ থেকে একের পর এক বহুবার সময় নিয়েছেন। নিয়েছেন আর্থিক অনুদানসহ সব সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি রাখেননি।”
এক যুগ আগে ট্যানারি পল্লী স্থানান্তরের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশ হাজারীবাগের বাসিন্দা, পরিবেশবিদ ও এ খাতের উদ্যোক্তারা।
“শিল্পটি স্থানান্তর না হওয়ায় আমাদের দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে বসবাস করতে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গা নদী ও আশপাশের এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে,” বেনারকে জানান ওই এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা মোহাম্মদ আব্দুল বারী।
অনেক আগেই প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে
২০০৩ সালে সাভারের কান্দিবৈলারপুর ও চন্দ্রনারায়ণপুর এবং কেরানীগঞ্জের চরনারায়ণপুর মৌজায় ১৯৯ দশমিক ৪০ একর জমিতে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে লক্ষ্যে ট্যানারি শিল্প মালিকদের মধ্যে ২০৫টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
২০০৩ সালের জুলাইয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। তৃতীয় দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পে ক্রম পুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ১৭৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
“হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিশেষ করে শিল্প, পরিবেশ ও বন, অর্থ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় পূর্বক মালিকদের বাধ্য করার লক্ষ্যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে,” এমন মত দিয়েছেন পরিবেশ বাচাঁও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান।
বেনারকে আবু নাসের জানান, “সিইটিপি নির্মাণ ও চালু করা এবং ট্যানারিগুলো সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তরের জন্য একাধিকবার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি, যা দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক।”
তবে একাধিক ট্যানারি মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা হাজারীবাগ এলাকা না ছাড়ার কারণ বলতে চাননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ট্যানারি মালিক বলেন, যুগ যুগ ধরে তারা এখানে যে ব্যবসা গড়ে তুলেছেন, তা সাভারে গেলে টিকে থাকবে কিনা, সেই সংশয় রয়েছে। নতুন শিল্পনগরীতে জনবল সংকট হবে, বাড়তি বিনিয়োগ করতে হবে। সব মিলিয়ে ঝুঁকিটা বেশি হয়ে যাবে।
“কোনো শক্তি এই অবস্থান থেকে আমাকে সরাতে পারবে না। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকারের। আমি সরকারের মন্ত্রী। আমার নির্দেশ সরকারের নির্দেশ। সরকারের নির্দেশ যারা মানবেন না সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পিছ পা হবে না,” জানান শিল্পমন্ত্রী।