দুই দশক আগে আর্সেনিক সমস্যা যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে
2016.04.06

রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে আর্সেনিকজনিত রোগে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। দুই দশক আগে আর্সেনিক সমস্যা যেমন ছিল, এখনও তেমন রয়ে গেছে। সরকার এই সমস্যার প্রতিকারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি ‘স্বজনপ্রীতি এবং অবহেলা: বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের খাবার পানিতে আর্সেনিক প্রতিরোধে ব্যর্থ প্রচেষ্টা’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগ: জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়লেও এটা প্রতিরোধে বাংলাদেশ কোন মৌলিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না। গবেষণায় ২০১৩ সালের একটি প্রতিবেদনের বরাতে বলা হয়, দেশের ২০ মিলিয়ন বা প্রায় দুই কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকির সংস্পর্শে রয়েছে, যা আক্রান্ত হওয়ার সমান। প্রতিবছর ৪৩ হাজার মানুষ আর্সেনিকজনিত রোগে মারা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রতি লিটার পানিতে ৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিকের মাত্রা গ্রহণযোগ্য।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিনিধিরা বলেন, দেশের ৬৫ হাজার মানুষ আর্সেনিকজনিত রোগে ভুগছে। তবে সংস্থাটি মনে করে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
এসব তথ্য ও অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক বেনারকে বলেন, “সংস্থাটি এই হিসাব কোথায়, কীভাবে পেয়েছে তা পরিষ্কার নয়। তা ছাড়া সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে তারা কোনো যোগাযোগ করেনি। তাই এ বিষয়ে এই মুহুর্তে কিছু বলতে চাই না।”
এইচআরডব্লিউয়ের প্রতিবেদনের অন্যতম পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সরকার এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকযুক্ত পানি পানে বিরত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা কিনা ক্যানসার ও অন্যান্য রোগের কারণ হতে পারে। এই ২ কোটি মানুষ বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার আট ভাগের এক ভাগ।
আক্রান্তদের চিকিৎসা হচ্ছে না
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করছে, আর্সেনিক মিশ্রিত পানি পান করায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোনো চিকিৎসাই আপাতত হচ্ছে না।
প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি এবং নতুন নতুন মানুষ আক্রান্ত হওয়ার তথ্য থাকলেও রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসায় সেই অর্থে অগ্রগতি নেই।
সরকারি নীতিমালায় ত্বকের সমস্যাকে আর্সেনিকে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা আছে।
তবে এইচআরডব্লিউয়ের দাবি, আর্সেনিক দূষণের শিকার অধিকাংশ মানুষের ত্বকে তেমন কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। বরং আর্সেনিকের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ক্যান্সার, হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তাই অনেকেরই জানা নেই যে তারা আর্সেনিক সমস্যায় আক্রান্ত।
আবার অনেকে বুঝলেও করার কিছু নেই। গবেষণা প্রতিবেদনে এক ব্যক্তি সাক্ষাৎকারে এইচআরডব্লিউকে জানিয়েছেন, বেশ কয়েকবছর আগে তার বাড়ির নলকূপে আর্সেনিকের পরিমাণ ছিল ২৫০ মাইক্রোগ্রাম। বিকল্প উপায় না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে ওই নলকূপের পানি তারা পান করতে বাধ্য হন।
ওই ব্যক্তি সম্প্রতি তার বুকে ও পায়ে ছোপ ছোপ দাগ লক্ষ্য করেছেন। এর আগে তার মা-বাবা মারা যান, যাদের শরীরেও এমন দাগ ছিল।
এইচআরডব্লিউ জানায়, ২০০০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া নয় কোটি শিশুর মধ্যে ১০ থেকে ৫০ লাখ শিশু মারা যাবে আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করার কারণে।
“বাংলাদেশ তার লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল সরবরাহে কোন সুস্পষ্ট মৌলিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না,” প্রতিবেদনে বলেছেন রিচার্ড পিয়ারসহাউজ, যিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একজন সিনিয়র গবেষক।
৭৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে তিনি বলছেন, সরকার এমন ভাব করছে যেন সমস্যার অধিকাংশই সমাধান হয়েছে। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক দাতারা এগিয়ে না এলে কোটি কোটি বাংলাদেশির মৃত্যু ঘটবে আর্সেনিক সংক্রান্ত প্রতিরোধযোগ্য রোগে।
নলকূপ বসাতে রাজনৈতিক প্রভাব
প্রতিবেদনে বলা হয়, নলকূপ পাওয়া বা বসানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবও কাজ করে। নিরাপদ বা আর্সেনিকমুক্ত পানির জন্য সরকারের তরফে গভীর নলকূপ দেওয়া হয়। সাংসদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
“বাংলাদেশের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের অনেক রাজনৈতিক নেতাই যেসব স্থানে নলকূপ বসানোর প্রয়োজন, সেই জায়গার পরিবর্তে তাদের সমর্থকদের পছন্দসই স্থানে নলকূপ বসানোর ব্যাপারে সাহায্য করেছেন,” প্রতিবেদনে অভিযোগ তোলা হয়।
এই অভিযোগ সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আর্সেনিক কবলিত অঞ্চল বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শিরীন আখতার বেনারকে বলেন, “এই অভিযোগ সবক্ষেত্রে সঠিক নয়। আমি রাজনৈতিক পরিচয়কে গুরুত্ব দেই না।”
শিরীন আখতার বলেন, “বাস্তবতা হচ্ছে, একটি গভীর নলকূপের বিপরীতে এত বেশি সংখ্যক আবেদনকারী থাকেন যে, ওই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অনেকক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। একটি এলাকায় গভীর নলকূপ দিলে অন্য এলাকার মানুষ অখুশি হন।চাহিদার তুলনায় সরবরাহ খুবই কম বলে সবার মন রক্ষা করা যায় না।”
তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, কিছু স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিবিদ এবং তাদের সমর্থক ও মিত্ররা নিজেদের প্রয়োজনে নলকূপ বসানোর স্থান ঠিক করে।
“নতুন নলকূপের প্রকল্প নির্বাচন মূলত পুরাটাই রাজনীতি,” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারি কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে এইচআরডব্লিউ।
“তারা তাদের রাজনৈতিক মিত্র, সমর্থক ও খুব ঘনিষ্ঠদের গভীর নলকূপ দেয়। এটা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। রাজনীতিবিদেরা বেশিরভাগ সময় মানুষের সত্যিকারের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয় না,” জানান ওই কর্মকর্তা।
খাদ্রা নামে রূপপুর গ্রামের একজন কৃষক হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, “বহু সরকারি নলকূপ ব্যক্তি মালিকানাধীন বাড়িতে স্থাপন করা হয়েছে।” তিনি বলেন, “ওই সব মালিকেরা সরকারি লোকজনদের ঘুষ দিয়ে কিংবা তাদের রাজনৈতিক সূত্রে এগুলো পেয়েছে।”
বেশিরভাগ উদ্যোগ সফল হয়নি
প্রতিবেদন তৈরীর সময় সংগঠনটি বিভিন্ন গ্রামের আর্সেনিক দূষণের শিকার ১৩৪ জন বাসিন্দার সাথে কথা বলেছে। তাদের মধ্যে পাঁচটি গ্রামে সরকারি নলকূপের রক্ষণাবেক্ষণকারী, সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরাও রয়েছেন।
২০০৬ সাল থেকে ২০১২ সাল নাগাদ সরকারি উদ্যোগে স্থাপিত এক লাখ ২৫ হাজার পানির উৎসের তথ্যও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ইউনিসেফ সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্থাপিত এসব নলকূপের পানি পরীক্ষায় সহায়তা করে। তখন ৮৫ শতাংশ নলকূপের পানি পরীক্ষা করা হয় বলে জানায় এইচআরডব্লিউ।
সংস্থাটি বলছে, এই সোয়া লাখ নলকূপের মধ্যে পাঁচ শতাংশে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বাংলাদেশে সহনীয় নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি।
পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা জাতীয় মাত্রার চাইতে বেশি হওয়ায় ইউনিসেফ ও বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে প্রায় পাঁচ হাজার নলকূপে লাল রং দিয়ে বিপজ্জনক চিহ্ন দেওয়া হয়। ওই কূপগুলো পরিবর্তন বা পূনরস্থাপন করা হয়েছে কিনা, তা এইচআরডব্লিউ নিশ্চিত হতে পারেনি।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০০৪ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আর্সেনিক দূষণের শিকার এলাকাগুলোয় প্রায় ১৩ হাজার টিউবওয়েল বসানো হয়। সেগুলো সঠিক জায়গায় বসানো হয়েছে কিনা সেব্যাপারেও তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ।
সংস্থাটি বলেছে, দাতাদের সহায়তায় স্থাপিত নলকূপগুলো দূষিত কিনা, তা দেখা উচিত।এ ছাড়া দূষিত চিহ্নিত হলে সেই কূপগুলো পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছে এইচআরডব্লিউ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের নিরাপদ পানি কেন্দ্র প্রকল্পে সকল আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর পর্যবেক্ষণ থাকা দরকার।
প্রতিবেদনের লেখক ও এইচআরডব্লিই’র জ্যেষ্ঠ গবেষক রিচার্ড পিয়ার্সহাউজ বলেন, বাংলাদেশ তার প্রত্যন্ত অঞ্চলের লাখো গরিব মানুষের খাওয়ার পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করার জন্য মৌলিক ও জরুরি পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে না।
“সরকারের আচরণ এমন যে, মনে হয় সমস্যার সমাধান অনেকাংশেই হয়ে গেছে। তবে আর্সেনিক দূষণের কারণে প্রাণহানি রোধে বাংলাদেশ সরকার ও আর্ন্তজাতিক দাতাদের আরও বেশি চেষ্টা করা উচিত,” মত দেন ওই গবেষক।