ঢাকায় 'কিশোর গ্যাং’ জড়িয়ে পড়ছে হত্যা ও সহিংসতায়

ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান
2017.01.23
আদনান কবির। ঢাকার উত্তরায় ডিসকো গ্রুপ ও নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। ফাইল ছবি
স্টার মেইল

বাংলাদেশে এতকাল কিশোরদের গ্যাংয়ের অস্তিত্বের কথা জানা যায়নি। দু’দল কিশোরের দ্বন্দ্ব, প্রচণ্ড গতিতে মোটর সাইকেল চালানো, ডিস্কোয় যাওয়া ছাড়া তেমন কোনো উৎপাতের খবর ছিল না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।

গত ৬ জানুয়ারি উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীর খুনের তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে নতুন তথ্য। জানা যায়, ডিসকো বয়েজ উত্তরা ও নাইন স্টার গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আদনান খুন হয়েছে।

এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই তেজকুনি পাড়ায় খুন হয় ১৬ বছরের কিশোর আজিজুল হক। ১৫ ডিসেম্বর মণিপুর স্কুলের দুইটি গ্যাং এর সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে মামলা হয় মিরপুর থানায়।

রাজধানীর উত্তরা থেকে তেজকুনি পাড়া, তেজকুনি পাড়া থেকে মিরপুর পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের এই উপস্থিতি নতুন করে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করেছে। কিশোর তরুণদের জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়া নিয়ে দেশজুড়ে যখন ব্যাপক আলোচনা, তার মধ্যেই খোঁজ পাওয়া গেলো অন্য এক বাজে সংস্কৃতির, যা অনেক দূর গড়িয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে।

“আসলে এখন আমাদের চিন্তার বিষয় হচ্ছে কিশোররা কেন বিপথগামী হচ্ছে,” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল গত সপ্তাহে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন। তিনি আরও বলেন, কিশোর অপরাধ রোধে আইন সংস্কার ও নীতিমালা প্রণয়নের কথাও সরকার চিন্তা করছে।

গ্যাংগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, উত্তরার গ্যাংগুলোর নেতৃত্বে আছে ২০-২২ বছরের কলেজ পড়ুয়া বা কলেজ থেকে ঝরে পড়া তরুণেরা। দুটি দলের প্রাধান্য বেশি। একটি ডিস্কো বয়েজ উত্তরা, অন্যটি নাইন স্টার।

নাইন স্টার গ্রুপের প্রধান রাজুর বয়স আনুমানিক ২০ বছর। তাঁর বাবা একসময় তালাচাবি সারাতেন বলে তিনি তালাচাবি রাজু নামে পরিচিত। ডিসকো বয়েজের প্রধান ছোটন খান। উত্তরার বাসিন্দা হলেও অন্য এলাকার একটি কলেজে ভর্তি হয়ে আছেন ছোটন।

উত্তরার প্রায় প্রতিটি নাম করা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী​দের অনেকেই এ দুটি গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। উত্তরা পশ্চিম থানা জানাচ্ছে, আট মাসে এই দুটি গ্যাং এর কিশোরেরা পুরো এলাকা কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এলাকার মাঠে কারা খেলবে, মোটর বাইক নিয়ে কারা রেইস দেবে, কে কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারবে—এসব নিয়ে কয়েকবার বিরোধে জড়িয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উত্তরায় দুই গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ নিয়ে পাঁচটি মামলা হয়েছে। চতুর্থ মামলাটি হয়েছিল নাইন স্টারের প্রধান মো. রাজু ওরফে তালাচাবি রাজুকে ছুরিকাঘাত করা নিয়ে। পঞ্চম মামলাটিই হলো খুনের মামলা। এই খুনের ঘটনা কিশোরেরা ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের উত্তরা জোনের উপকমিশনার বিধান ত্রিপুরা।

আদনানের ওপর হামলার আগে ‘ডিস্কো’ গ্রুপের ফেসবুক পাতায় এই ছবি পোস্ট করা হয়, যাতে কয়েকজনের হাতে লাঠি-রড দেখা যাচ্ছে। ফাইল ফটো।
আদনানের ওপর হামলার আগে ‘ডিস্কো’ গ্রুপের ফেসবুক পাতায় এই ছবি পোস্ট করা হয়, যাতে কয়েকজনের হাতে লাঠি-রড দেখা যাচ্ছে। ফাইল ফটো।
স্টার মেইল
“আদনান টার্গেট কিলিংয়ের শিকার। সে যে গ্যাংয়ের সদস্য, সেই গ্যাংয়ের ছেলেরা অন্য গ্যাংয়ে​র এক ছেলেকে পিটিয়েছিল। তখন থেকেই সে টার্গেট ছিল,” বেনারকে জানান উত্তরা পুলিশের উপকমিশনার বিধান ত্রিপুরা।

তিনি আরও বলেন, উত্তরায় আমরা কিশোরদের কোনো অপরাধে জড়াতে দেখলে আটক করে পরিবারের কাছে সোপর্দ করছি।

পুলিশ জানায়, ওই ঘটনায় তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে। তিনজনই এখন কিশোর আদালতে। তাদের একজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। সে স্বীকার করেছে, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আদনান খুন হয়।

তেজকুনি পাড়ায় আজিজুল হক একটি রিকশা গ্যারেজের শ্রমিক। বাড়ির সামনের একটি মাঠে অবসর সময়ে খেলতে যেত। সেখানে কে বড় ভাই, কে ছোট ভাই তা নিয়ে বিরোধের জেরে ১৮ ডিসেম্বর খুন হয় আজিজুল। ওই ঘটনায়ও তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে। দুজনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। তারাও খুনের কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।

মিরপুরে মণিপুর স্কুলের এক ছাত্রের অনুসারীরা অন্য ছাত্রের অনুসারীদের সঙ্গে বিরোধে জড়ায়। বিরোধ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছালে মিরপুর থানার অতিরিক্ত উপকমিশনার কামাল হোসেন মামলা নেন।

“একটি ছেলেকে বেদম মারপিট করা হয়েছিল। তার বাবা এসে অভিযোগ দিলে সঙ্গে সঙ্গে মামলা নিই ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করি। দুঃখজনক হলো অপরাধী তারই সহপাঠী,” বেনারকে বলেন কামাল হোসেন।

উত্তরা, তেজকুনিপাড়া ও মিরপুর—তিনটি জায়গাতেই কিশোরদের গ্যাংগুলো প্রাণঘাতী কাজে যুক্ত হচ্ছে। তবে তাদের হাতে সে অর্থে বড়সড় অস্ত্র নেই।

উত্তরার ট্রাস্ট স্কুলের একজন ছাত্র তার শার্টের হাতা গুটিয়ে এ প্রতিবেদককে দেখিয়েছে কীভাবে লোহার স্কেলের মাথা ছুঁচোলো করে একদল কিশোর তার কবজির ওপর থেকে কনুই পর্যন্ত লম্বা করে কেটে দেয়। একই এলাকার একজন মুরগি বিক্রেতা দেখিয়েছেন, কীভাবে ওই ছেলেরা তাঁর পিঠে আঘাত করেছে।

তবে তেজকুনিপাড়ার কিশোরেরা আজিজুলকে খুন করেছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে।

“আজিজের মাথার ডান পাশে ধারালো অস্ত্রের আঘাত, ডান পাশে চোখের ওপর জখমের চিহ্ন, গলার ডান পাশে আঘাত, বুকের বাঁ পাশে জখম রয়েছে,” বেনারকে বলেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন কিশোরেরা অনেক সময় বীরত্ব দেখাতে গিয়ে অপরাধে জড়ায়।

“বীরত্ব দেখানোটা কিশোরদের স্বাভাবিক প্রবণতার মধ্যেই পড়ে। আগেও পাড়া-মহল্লায় এসব ঘটনা ঘটত। তবে পার্থক্য হলো এখন কিশোরেরা সহিংস হয়ে উঠছে। জুভেনাইল সাব কালচার বলে যে জিনিসটা পশ্চিমা বিশ্বে আছে, আমাদের কিশোরেরা তার অনুকরণ করছে,” বেনারকে বলেন শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, পরিবার ও এলাকার মুরব্বিদের দায়িত্ব এখন সবচেয়ে বেশি। তারা গভীর রাতে বাইরে থাকার অনুমতি পাচ্ছে অভিভাবকের কাছ থেকেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে কৈশোর-তারুণ্য বিষয়ে পড়ান তৌফিকুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, মুঠোফোন ও ইন্টারনেট যোগাযোগ কিশোরদের অনেক বেশি অপরাধপ্রবণ করছে।

ওই শিক্ষক জানান, আদনান কবীরকে হত্যার আগে কিশোরেরা একই রকম জামা গায়ে দিয়ে, হাতে হকিস্টিক ও লাঠিসোঁটা নিয়ে মহড়া দেওয়ার ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছিল।

তৌফিকুল ইসলাম মনে করেন, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী ছেলেরা বেসিক ফোন ব্যবহার করবে এবং তাদের পাসওয়ার্ড অভিভাবকেরা জানবেন—এমনটিই হওয়া উচিত।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।