কিশোর আদনান খুনের ঘটনায় দুই গ্যাংয়ের আটজন গ্রেপ্তার
2017.02.08

‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘বিগ বস’ হাত মিলিয়েছিল বেশ আগেই। উদ্দেশ্য ছিল নাইন স্টার গ্রুপের রাজু ওরফে তালাচাবি রাজুকে শিক্ষা দেওয়া। ৬ জানুয়ারি রাজুকে হত্যার উদ্দেশে বেরিয়ে তারা খুন করে ১৪ বছরের কিশোর আদনান কবীরকে।
গত মঙ্গলবার রাতভর অভিযান চালিয়ে র্যাব আদনান কবীরের ‘খুনি’সহ আটজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। ৬ জানুয়ারি ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীর খুন হন। আদনান খুনের পর ঢাকার মানুষ প্রথমবারের মতো শহরে ভয়াবহ গ্যাং কালচার গড়ে ওঠার কথা জানতে পারে।
র্যাব বলছে, ৭ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালিয়ে প্রথমে আদনান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ডিসকো বয়েজের নেতা শাহরিয়ার বিন সাত্তার সেতু ওরফে রায়হান আহম্মেদ সেতু ওরফে ডিসকো সেতুকে গ্রেপ্তার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এজাহারভুক্ত ৫ নম্বর আসামি বিগ বস গ্রুপের দলনেতা আক্তারুজ্জামান ছোটনসহ বাকি ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গতকাল বুধবার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।
“গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে জাহিদুল ইসলাম জুইস নিজে হাতে আদনান কবীরকে কুপিয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে আমরা এমন তথ্য পেয়েছি। আদনানকে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে ও ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়,” জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।
মুফতি বলছিলেন, ৩ জানুয়ারি ডিসকো বয়েজ ও বিগ বস গ্রুপ নাইন স্টারের দলনেতা রাজুকে ১৩ নম্বর ব্রিজের ওপর তুলে বেধড়ক পেটায়। ডিসকো বয়েজের কাউকে হাতের কাছে না পেয়ে নাইন স্টার গ্রুপ ৫ জানুয়ারি আজমপুর পদচারী সেতুর নিচে বিগ বস গ্রুপের আক্তারুজ্জামান ওরফে ছোটনকে পেটায়। দুটি দলই পরে এক হয়ে নাইন স্টার গ্রুপের তালাচাবি রাজুকে খুঁজতে শুরু করে। না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তারা আদনানের ওপর হামলা চালায়।
জানতে চাইলে আদনান কবীরের বাবা কবীর হোসেন বেনারকে বলেন, তিনি শুরু থেকেই বলে আসছেন তাঁর ছেলে ঘটনার শিকার। জুইস তাঁর ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে এ খবর তিনি জেনেছেন। কিন্তু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী অনিক এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে।
“উত্তরার পুলিশ মেহেরাব হোসেন, রনি, সোহাগ ও সাফিনকে গ্রেপ্তার করে। ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে তারা সবাই জুইসের কথা বলেছে। কিন্তু এজাহারে এক নম্বর আসামি অনিক ধরা পড়েনি। আদনান খুন হওয়ার পর সপরিবারে তারা পালিয়ে গেছে,” জানান কবীর হোসেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের পরিচয়
গ্রেপ্তার হওয়া আটজনের মধ্যে দুজন কিশোর। অন্য ছয়জন হচ্ছে; ডিসকো বয়েজ এর দলনেতা শাহরিয়ার বিন সাত্তার ওরফে সেতু (২২), বিগ বস গ্রুপের নেতা মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে ছোটন (১৯), সেলিম খান (২৩), ইবরাহিম হোসেন ওরফে সানি (২৮), মিজানুর রহমান (২২) ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে জুইস (২১)। এরা প্রত্যেকেই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে র্যাব জানিয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে শাহরিয়ার বিন সাত্তার ওরফে সেতু ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ছাত্র। তার বাবা বিমানবন্দরের সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট। ডিসকো গ্রুপের অপর সদস্য জাহিদুল ইসলাম জুইস উত্তরা স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। তার বাবা একজন মুদি দোকানদার।
অন্যদিকে বিগ বস গ্রুপের সদস্যরা নিম্নবিত্ত পরিবারের। এদের মধ্যে বিগ বস গ্রুপের প্রধান আক্তারুজ্জামান ওরফে ছোটন ইউনিক এডুকেয়ারে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ও তার ভাই সুমন এইচএসসি পাস করেছে। দুজনই পেশায় ছিল হকার। এর বাইরে ইবরাহিম ইজিবাইক চালায়, সেলিম একটি গার্মেন্টসে কাজ করে, রমজান সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা করে এবং শাহীন পরিবহন খাতে চাকরি করে।
কমপক্ষে ৩০টি গ্যাং এর অস্তিত্ব আছে
শুধু উত্তরাতেই ৩০টি গ্যাং এর কথা জানতে পেরেছে র্যাব। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, কাঁকড়া, জি ইউনিট, ব্ল্যাক রোজ, রনো, কে নাইট, ফিফটিন, পোটলা বাবু, সুজন, আলতাফ, ক্যাসল বয়েজ ও ভাইপার। দলগুলোয় কয়েকশ সদস্য যুক্ত হয়েছে।
তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানতে পারে যে, উত্তরার নামী-দামি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যেমন আছে, তেমনি আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরাও। সবার আর্থ-সামাজিক অবস্থাও এক নয়। উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোর-তরুণেরা এসব গ্যাং এর সদস্য।
তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে সক্রিয় ডিসকো বয়েজ, বিগ বস ও নাইন স্টার বা নাইন এমএম। ডিসকো বয়েজ ও বিগ বস উত্তরার শেষ প্রান্ত, আবদুল্লাহপুর, বেড়িবাঁধ, কোট বাড়ি ও ফায়েদাবাদ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত।
নাইন স্টার গ্রুপের দখলে আছে উত্তরা ১২, ১৩, ১৪, খালপাড়, দিয়াবাড়ি ও বাউনিয়া বাঁধ এলাকা।
গ্যাং এর সদস্যরা এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে, র্যাগিং করে, ছাত্রদের উত্ত্যক্ত করে, মাদক কেনাবেচা, ছিনতাই, অশ্লীল ভিডিও শেয়ার করার মতো কাজও করে থাকে।
কিশোরেরা ভয়ংকর অপরাধে জড়াচ্ছে
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে কিশোর অপরাধীদের জন্য (ছেলে) দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। এই কেন্দ্রগুলো ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপরাধের হাল নাগাদ তালিকা করে। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ছিঁচকে চুরি ও ঘর পালানোর মতো অপরাধ ছেড়ে এখন কিশোর তরুণেরা সহিংসতায় জড়াচ্ছে।
দেখা গেছে, ওই দিন কেন্দ্র দুটিতে ৫৯৭ জন কিশোর ছিল। তাদের মধ্যে ১২০ জন হত্যা মামলার আসামি। ১৪২ জন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলা এবং ৯ জন তথ্যপ্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফি আইনে করা মামলার আসামি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে কিশোর অপরাধ নিয়ে পড়ান শেখ তৌফিকুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়া এবং প্রযুক্তির অপব্যবহার শিশুদের সহিংস করে তুলছে।
“শিশুরা সহিংসতার প্রথম পাঠ পাচ্ছে ভিডিও গেমস থেকে। তারপর ঝুঁকছে পর্নোগ্রাফির দিকে। এসব মিলে শহরের শিশুরা সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে,” জানান তৌফিক।