বর্ধমান বিস্ফোরণের মূল পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার
2015.09.30

আর ঠিক এক দিন পরেই এক বছর পূর্ণ হবে বর্ধমানের খাগড়াগড় বোমা বিস্ফোরণের। তার আগেই, গত কাল মঙ্গলবার বিকেলে ঝাড়খণ্ডের রাঁচি থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে রামগড়ে গ্রেফতার হল বিস্ফোরণ-কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত তারিকুল ইসলাম ওরফে সাদিক।
কে এই তারিকুল ইসলাম? ভারতের তদন্তকারী সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি বা এনআইএ-এর সূত্রে জানা গেল, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ-এর (জেএমবি) কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মজলিস-ই-সুরা-র অন্যতম সদস্য এই তারিকুল ইসলাম। তবে, ২০১১ সাল থেকে সে অতি নিয়মিত ভারতে আসছে। ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলায় এক মহিলাকে বিয়ে করে সেই সূত্রে ভারতের নাগরিক হিসেবে সচিত্র পরিচয়পত্রও জোগাড় করেছিল সে।
তবে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আদালতের বিচারেই প্রকৃত তথ্য উদঘাটিত হবে।
ঝাড়খণ্ড পুলিশের সন্ত্রাসদমন শাখা এবং এনআইএ-এর যৌথ অভিযানেই গ্রেফতার হল তারিকুল ইসলাম ওরফে সাদিক। এনআইএ সূত্রের অভিমত, বর্ধমান কাণ্ডে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ গ্রেফতারির ঘটনা এটাই। কারণ, বাংলাদেশ থেকে ভারতের মাটিতে চালানো সন্ত্রাসের অন্যতম প্রধান মুখ এই সাদিক। বর্ধমান বিস্ফোরণন কাণ্ডেরও মূল পাণ্ডা সে। এনআইএ-র এক অফিসার বললেন, সাদিকের মাথার দাম ছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। ওকে গ্রেফতার করার পর দেখছি, এর অন্তত দ্বিগুণ দাম ধার্য করা উচিত ছিল।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছিল সাদিক। বার বার ডেরা বদল করছিল, বদলে ফেলছিল মোবাইল ফোনের সিম কার্ডও। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দেওয়া খবরের ভিত্তিতে তাকে ধাওয়া করেই গ্রেফতার করল ঝাড়খণ্ড পুলিশ। তাকে জেরা করে বর্ধমান বিস্ফোরণ-কাণ্ড সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু জানা যাবে বলেই গোয়েন্দাদের অভিমত। আগামীকাল বৃহস্পতিবার কলকাতার আদালতে তাকে পেশ করা হবে।
বিস্ফোরণ-কাণ্ড
গত বছর ২ অক্টোবর। জাতির জনক মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিনের ছুটি দেশজুড়ে। তারই মধ্যে বর্ধমানের খাগড়াগড়ের একটি দোতলা বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটল। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, গ্যাস সিলিন্ডারে আগুন লেগেই বিস্ফোরণ। কিন্তু, সেই বাড়ি থেকেই উদ্ধার হল পঞ্চাশটিরও বেশি বিস্ফোরক। বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা গেল এক যুবক, আহত আর এক জন। তবে, তাদের দুই স্ত্রী এবং সন্তান অক্ষত ছিল।
বিস্ফোরণ-কাণ্ডের তদন্তে নেমে রাজ্য পুলিশ প্রথমেই বিস্ফোরকগুলিকে নষ্ট করে ফেলল। অন্যান্য প্রমাণ লোপেরও অভিযোগ উঠল পুলিশ এবং সিআইডি-র বিরুদ্ধে। তদন্তের দায়িত্ব পেল এনআইএ। এবং, ক্রমে প্রকাশ পেল, এই ঘটনার সঙ্গে অতি স্পষ্ট বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি-র যোগাযোগ।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস
গত মার্চ মাসে এই মামলার চার্জশিট পেশ করে এনআইএ। জানায়, পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায়, বিশেষত মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদিয়া, বর্ধমান ও বীরভূমে জেএমবি-র নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অসমের বরপেটা এবং ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ ও পাকুড় জেলা। কী ভাবে প্রতিপত্তি বিস্তার করছে এই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন?
এনআইএ-র এক তদন্তকারী অফিসার জানালেন, “মূলত অনথিভুক্ত মাদ্রাসার মাধ্যমেই কাজ করে সংগঠনটি। যে জেলাগুলিতে তাদের প্রতিপত্তি তৈরি হয়েছে, সেখানে বেশ কিছু যুবককে বাছাই করে এই মাদ্রাসাগুলিতে আনা হয় এবং তাদের জেহাদি আদর্শে অনুপ্রাণিত করা হয়, সন্ত্রাসী কাজকর্মের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।”
মাসকয়েক আগে এনআইএ সূত্রে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে কট্টরপন্থী শরিয়া শাসন প্রবর্তন করতে চায় এই জঙ্গিরা। কিন্তু, তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ জড়িয়ে গেল কী ভাবে? এনআইএ তার চার্জশিটে জানিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে মূলত জঙ্গি নিয়োগ করা হচ্ছে। দুই বাংলার ভাষাগত মিলের কারণেই কাজটি সহজ।
পাশাপাশি, কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দীপক আইচ মনে করিয়ে দিলেন, কয়েক মাস আগে ঢাকায় গ্রেফতার হয়েছিল জেএমবি-র কয়েক জন শীর্ষ নেতা। তখনই বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের সূত্রে জানা যায়, জেএমবি-র সঙ্গে আইএসআইএস-এর সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। সেই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের গল্পে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশি সন্ত্রাসবাদীদের কাছে কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গ চির কালই গুরুত্বপূর্ণ, বললেন দীপক আইচ। তারা এই রাজ্যকে মূলত ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে। রাজ্যের বহু অঞ্চলেই জঙ্গিদের ডেরা রয়েছে। যেহেতু এই রাজ্যটিকে তারা নিরাপদ আশ্রয় বলে মনে করে, পশ্চিমবঙ্গে সন্ত্রাসী তৎপরতা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। দীপকবাবুর মতে, এই প্রেক্ষিতেই খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ড খুব তাৎপর্যপূর্ণ। সে বিস্ফোরণ যদিও ভুলক্রমে ঘটেছে, তবুও পশ্চিমবঙ্গে বিস্ফোরকের স্তূপ জমছে, সে কথা স্পষ্ট। এনআইএ-এর চার্জশিটেও বলা হয়েছে, রাজ্যে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও অস্ত্রশস্ত্র মজুত রয়েছে।
রাজনীতি, কূটনীতি
ভারতে সন্ত্রাসের সঙ্গে বাংলাদেশি সংগঠনের এমন নিবিড় সম্পর্ক কি দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে? দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষক সারণি মুখোপাধ্যায় দণ্ডপাট বললেন, তেমনটা যাতে না হয়, সে বিষয়ে ভারতকেই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় আগাগোড়া ভারতের পাশে থেকেছে। তার মর্যাদা দেওয়ার দায়িত্ব ভারতেরই।
তবে, রাজনীতির জল গড়াচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পশ্চিমবঙ্গ শাখার নেতা শচীন্দ্রনাথ সিংহ বললেন, আমরা মানুষের কাছে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের সমস্যার কথা তুলে ধরছি। কী ভাবে জেএমবি-র মতো জঙ্গি সংগঠন এই রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করছে, মানুষ দেখছেন।
পশ্চিমবঙ্গের যে জেলাগুলিতে অনুপ্রবেশের হার সর্বোচ্চ, উত্তর চব্বিশ পরগনা তার মধ্যে একটি। জেলার বামপন্থী নেতা আবুবকর লস্কর বললেন, এই কঠিন সময়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সাধারণ মুসলমানদের এক করে দেখার একটি রাজনৈতিক চেষ্টা হচ্ছে, হবে। সেটা ঠেকিয়ে রাখাই এখন বড় কাজ।